০৩. মাজহার, মাজহার-পত্নী তাদের শিশুপুত্র অমিয় এবং টমিও।
মাজহারের একটি পরিচয় আগেই দিয়েছি, তারচেয়ে বড় পরিচয় সেও আমার নাটকের একজন অভিনেতা। তার এক মিনিটের একটি দৃশ্য আমি পুরো একদিন শুট করার পর ফেলে দিয়ে বাসায় চলে আসি। পরের দিন আমার হয়ে শাওন সেই দৃশ্য শুট করতে যায়। আমি নিশ্চিত ছিলাম সে পারবে। সে আমার মতো অধৈর্য না। তার ধৈর্য বেশি। সে এক মিনিটের এই দৃশ্য শুট করতে দেড় দিন সময় নেয়। শুটিং শেষে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাজহার কেমন করেছে? সে খড়খড়ে গলায় বলেছে, তুমি জানো না সে কেমন করেছে? সব বন্ধু-বান্ধবকেই অভিনেতা বানাতে হবে?
আমি এখনো আশাবাদী। কারণ আমার চিফ অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর (জুয়েল রানা) আমাকে বলেছে যে, মাজহার স্যারের না-সূচক মাথা নাড়া এবং হা-সূচক মাথা নাড়া খারাপ হয় নি। প্রায় ন্যাচারাল মনে হয়েছে।
মাজহার-পত্নী স্বর্ণা সিলেটের মেয়ে। মা স্বভাবের মেয়ে। মাতৃভাব অত্যন্ত প্রবল। দীর্ঘদিন ধরে তাকে চিনি। তার মুখ থেকে এখনো কারো প্রসঙ্গে একটি মন্দ কথা শুনি নি। স্বর্ণা স্বামীর অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ। স্বামীর প্রথম অভিনয়ের দিন সে মানতের রোজা রেখেছে। শাহজালাল সাহেবের দরগায় বিশেষ মোনাজাতের ব্যবস্থা করেছে।
এই দম্পতির একমাত্র পুত্রসন্তান অমিয়। নামটা রেখেছেন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। মাজহার পুত্রের নামের জন্যে আমার কাছে প্রথম এসেছিল।
আমি নাম রেখেছিলাম-অরণ্য। মাজহার এই নাম রাখে নি, কারণ এই নামের একটা বাচ্চাকে সে চেনে। সেই বাচ্চা খুবই দুষ্টু প্রকৃতির। অরণ্য নাম রাখলে বাচ্চা বন্যস্বভাবের হয়ে যেতে পারে।
‘যে যার নিন্দে তার দুয়ারে বসে কান্দে। আমাদের অমিয় (বয়স চার) মাশাল্লাহ অতি দুষ্টু প্রকৃতির হয়েছে। তার সঙ্গে খেলতে এসে তার হাতে মার খায় নি এমন কোনো শিশু নেই। কামড় দিয়ে রক্ত বের করার বিষয়েও সে ভালো দক্ষতা দেখাচ্ছে। এই দিকে সে আরো উন্নতি করবে বলে সবারই বিশ্বাস। বেইজিং-এর ম্যাগডোনাল্ড রেস্টুরেন্টে বার্গার খাওয়ার সময় সে ফ্লাইং কিক দিয়ে দুই চায়নিজ বাচ্চাকে একই সঙ্গে ধরাশায়ী করে রেস্টুরেন্টের সবার প্রশংসাসূচক দৃষ্টি লাভ করেছে।
তার বিষয়ে একটি গল্প এখনই বলে নেই, পরে ভুলে যাব।
আমি কোনো একটি পত্রিকায় ইন্টারভ্যু দিচ্ছি। বিষয়বস্তু বাংলাদেশের ছোটগল্পের ভবিষ্যৎ’। অতি জটিল বিষয়। যিনি ইন্টারভ্যু নিচ্ছেন তিনি কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করছেন, যার উত্তর আমি জানি না। মোটামুটি অসহায় বোধ করছি। আমার পাশে নিরীহ মুখ করে অমিয় বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ইন্টারভ্যু নামক বিষয়টাতে যথেষ্ট মজা পাচ্ছে। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন একটু বলুন, বাংলাদেশের কোন কোন গল্পকার কাফফাঁকে অনুসরণ করেন?
উত্তরের জন্যে আমি আকাশ-পাতাল হাতড়াচ্ছি, এমন সময় আমার গালে প্রচণ্ড এক চড়। আমার প্রায় পড়ে যাবার মতো অবস্থা। প্রথমে ভাবলাম–প্রশ্নকর্তা আমার মূর্তায় বিরক্ত হয় চড় লাগিয়েছেন। ধাতস্থ হয়ে বুঝলাম প্রশ্নকর্তা না চড়
দিয়েছে অমিয়। আমি উত্তর দিতে দেরি করায় সে হয়তো বিরক্ত হয়েছে। প্রশ্নকর্তা ভীত গলায় বলল, স্যার এই ছেলে কে?
আমি বললাম, অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের ছেলে। সে বলল, আপনাকে মারল কেন?
আমি বললাম, ছেলে তার বাবার মতো হয়েছে। সাহিত্য পছন্দ করে না। সাহিত্য বিষয়ক কোনো আলোচনাও পছন্দ করে না। ইন্টারভ্যু এই পর্যন্ত খাক।
জি আচ্ছা থাক।
এত সহজে প্রশ্নকর্তা যে তার ইন্টার বন্ধ করল তার আরেকটি কারণ ইতিমধ্যে অমিয় প্রশ্নকর্তার ক্যামেরার উপর ঝাপ দিয়ে পড়েছে। ক্যামেরা নিয়ে দু’জনের দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছে।
অমিয়’র চড় খেয়ে আমি তেমন কিছু মনে করি নি। তার কারণ সে আমাকে ডাকে-বুব ধু। বুব বু’র অর্থ বন্ধু। বন্ধু বলতে পারে না, বলে খুব বু। একজন বন্ধু আরেক বন্ধুর গালে চড়-থাপ্পর মারতেই পারে।
ও আচ্ছা টমিওর কথা বলা হয় নি। অমিয়র ভাই টমিও মায়ের পেটে। তার এখনো জন্ম হয় নি। সে মায়ের পেটে করে বেড়াতে যাচ্ছে।
০৪. স্বাধীন খসরু। অভিনেতা।
সে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে না। কারণ সে আছে ইংল্যান্ডে। তার সঙ্গে কথা হয়েছে সে সরাসরি ইংল্যান্ড থেকে বেইজিং-এ চলে আসবে। সে অভিনয় শিখেছে লন্ডন স্কুল অব ড্রামা থেকে। যে স্কুল পৃথিবীর অনেক বড় বড় অভিনেতার জন্ম দিয়েছে। উদাহরণ-এলিজাবেথ টেলর, পিটার ও টুল…। সে ইংল্যান্ডের সব ছেড়ে-ছুঁড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে শুধুমাত্র অভিনয়ের আকর্ষণে। আমার সব নাটকেই তাকে দেখা যায়। সে নাম করেছে তারা তিনজন’-এর একজন হিসেবে। দেশের বাইরে তার জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। তাকে নিয়ে একবার আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে গিয়েছিলাম। বাঙালি সমাজ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আনন্দময় দৃশ্য। ছেলে হিসেবে সে অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ। অতি তুচ্ছ কারণে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে-এটি নিত্যদিনকার দৃশ্য। তার গত জন্মদিনে আমরা তাকে নরসিংদীর বিশাল এক গামছা উপহার দিয়েছি। উপহারপত্রে লেখা ‘পবিত্র অশ্রুজল মোছার জন্যে।