রোগের শেষ পর্যায়ে লেখক ঘোষণা করেন তিনি আর লেখালেখি করবেন। অনেক হয়েছে। …… ছাল’ লিখে ফায়দা নেই। [ছালের আগের শব্দটা বুদ্ধিমান পাঠক গবেষণা করে বের করে নিন।] লেখকের মুখের ভাষা বস্তি লেভেলে নেমে আসে। তাঁর মধ্যে কাজী নজরুল সিনড্রম দেখা যায়। হাতের কাছে যাই পান তাই ছিঁড়ে ফেলেন। নিজের পুরনো লেখা, টেলিফোন বিল, ইলেকট্রিসিটি বিল সব শেষ। তারপর এক অনিদ্রার মধ্যরাতে স্ত্রীকে ডেকে তুলে শান্ত গলায় বলেন, আমি বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সুইসাইড করব। তোমার কাছে থেকে বিদায় নেবার জন্যে তোমার কাঁচাঘুম ভাঙিয়েছি। তার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। এখন দয়া করে একুশটা ঘুমের ওষুধ আমাকে দাও আর এক গ্লাস ঠা পানি।
কোনো কোনো পাঠক হয়তো ভাবছেন আমি writer’s Block নামক রোগটা নিয়ে রসিকতা করছি। তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এই পৃথিবীর অনেক লেখক (খ্যাত এবং অখ্যাত) এই ভয়াবহ অসুখের শেষ পর্যায়ে এসে আত্মহত্যা করেছেন। এই মুহূর্তে যাদের নাম মনে পড়ছে তারা হলেন
কবি মায়াকোভস্কি (রাশিয়া)
ঔপন্যাসিক হেমিংওয়ে (নোবেল প্রাইজ বিজয়ী, আমেরিকান)
ঔপন্যাসিক কাওয়াবাতা (নোবেল প্রাইজ বিজয়ী, জাপানি)
কবি জীবনানন্দ দাশ (বাংলাদেশ)
বিখ্যাতদের মতো অতি অখ্যাতরাও যে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন তার উদাহরণ আমি। গত শীতের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ আমাকে এই রোগে ধরল। কঠিনভাবে ধরল। এক গভীর রাতে শাওনকে ডেকে তুলে বললাম, কোথা সে ছায়া সখি কোথা সে জল? কোথা সে বাধাঘাট অশ্বত্থল?’ সে হতভম্ব হয়ে বলল, এর মানে?
আমি বললাম, তুমি খুব আগ্রহ করে একজন লেখককে বিয়ে করেছিলে। সেই লেখক কিছু লিখতে পারছেন না। কোনোদিন পারবেনও না। আমি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। লেখকের সঙ্গে জীবনযাপনের আগ্রহ তারপরেও যদি তোমার থাকে, তুমি অন্য লেখক খুঁজে বের কর। আমি শেষ। আসসালামু আলায়কুম।
জীবন সংহারক রাইটার্স ব্লকের কোনো ওষুধ নেই। এন্টিবায়োটিক বা সালফা ড্রাগ কাজ করে না, তবে সিমটোমেটিক চিকিৎসার বিধান আছে। সিমটোমেটিক চিকিৎসায় লেখককে অতি দ্রুত তিনি যে পরিবেশে বাস করেন সেখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তার প্রিয়জনরা সবাই তার আশেপাশে থাকবেন, তবে লেখালেখি বিষয়ে কেউ তার সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারবেন না। লেখকের সঙ্গে কোনো বিষয়েই কেউ তর্কে যাবেন না। তিনি যা বলবেন সবাই ‘গোপাল বড়ই সুবোধ বালকের মতো তাতে সায় দেবে।
আমার লেখক বুক দূর করার ব্যবস্থা হলো। প্রধান উদ্যোগী অন্যপ্রকাশের মাজহার। আমার এই অসুখে সে-ই সবচে’ ক্ষতিগ্রস্ত। আমি বই না লিখলে সে ছাপবে কী? সামনেই একুশের বইমেলা!
মাজহার এক সকালবেলা অনেক ভণিতার শেষে বলল, আমি জানি আপনি দেশের বাইরে যেতে চান না। চলুন না ঘুরে আসি। আপনি লেখালেখি করতে পারছেন না।-এটা কোনো ব্যাপার না। সারাজীবন লেখালেখি করতে হবে তাও তো না। এক জীবনে যা লিখেছেন যথেষ্ট। এমনি একটু ঘুরে আসা। আপনি হ্যাঁ বললে খুশি হবো।
আমি বললাম, হ্যাঁ।
আনন্দে মাজহারের কালো মুখ বেগুনি হয়ে গেল। হিসাব মতো তার মুখে বত্রিশটা দাঁত থাকার কথা, সে কীভাবে যেন চল্লিশটা দাঁত বের করে হেসে ফেলল।
হুমায়ূন ভাই, কোথায় যেতে চান বলুন-ইন্দোনেশিয়ার বালি, মালয়েশিয়ার জেনটিং, থাইল্যান্ডের পাতায়া/ফুকেট, মরিশাস, মালদ্বীপ।
আমি বললাম ড্রাগন দেখতে ইচ্ছা করছে। চীনে যাব।
মাজহারের মুখের ঔজ্জ্বল্য সামান্য কমল। সে আমতা আমতা করে বলল, চীনে এখন ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। টেম্পারেচার শূন্যেরও নিচে….
আমি আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বললাম, চীন।
মাজহারের মনে পড়ল রাইটার্স ব্লকের রোগীর সব কথায় সায় দিতে হয়। সে বলল, অবশ্যই চীন। আমরা গরম দেশের মানুষ। ঠাণ্ডা কী জানি না। হাতে কলমে ঠাণ্ডা শেখার মধ্যেও মজা আছে।
হঠাৎ করে আমার মাথায় চীন কেন এলো বুঝতে পারলাম না। এমন না যে আমি চীন দেখি নি। পনেরো বছর আগে একবার গিয়েছিলাম। প্রায় একমাস ছিলাম। চীন দেশের নানান অঞ্চলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই দেশে আরেকবার না গিয়ে অন্য কোথাও যাওয়া যেত। কিন্তু আমার মাথায় বাচ্চাদের মতো ঘুরছে-চীন, চীনের ড্রাগন।
সফরসঙ্গীর দীর্ঘ তালিকা তৈরি হলো। রাইটার্স ব্লক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীকে একা ছাড়া যাবে না। তার চারপাশে বন্ধুবান্ধব থাকতে হবে।
আমার সফরসঙ্গীরা হলেন–
০১. চ্যালেঞ্জার এবং চ্যালেঞ্জার-পত্নী। চ্যালেঞ্জার একজন অভিনেতা। বেচারী একদিন নুহাশ চলচ্চিত্রে নাটকের শুটিং দেখতে এসেছিল। নাপিতের এক চরিত্রে কাউকে অভিনয় করার জন্যে পাচ্ছিলাম না। তাকে ধমক দিয়ে জোর করে নামিয়ে দিলাম। আজ সে বিখ্যাত অভিনেতা। শুনেছি বাংলাদেশের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে তার সম্মানী সর্বোচ্চ। চ্যালেঞ্জার-পত্নী স্কুল শিক্ষিকা। স্বামীর প্রতিভায় তেমন মুগ্ধ না তবে স্বামীর নানাবিধ যন্ত্রণায় কাতর।
০২. কমল, কমল-পত্নী এবং কন্যা আরিয়ানা।
কমলও আমার নাটকের অভিনেতা। ডায়ালগ ছাড়া অভিনয়ে সে অতি পারঙ্গম। ডায়ালগ দিলেই নানা সমস্যা। তোতলামি, মুখের চামড়া শক্ত হয়ে যাওয়া, হাত-পা বেঁকে যাওয়া শুরু হয়। সে আমার নাটকে অতি দক্ষতার সঙ্গে, রাইফেল কাঁধে মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তান আর্মির সেপাই, পথচারী, দুর্ভিক্ষে মৃত লাশের ভূমিকা করেছে। এই মহান অভিনেতা অভিনয়ের জন্য কোনো সম্মানি দাবি করেন না। ডেডবডির ভূমিকায় তিনি অনবদ্য। ডেডবডির ভূমিকায় এক বটগাছের নিচে তিনি আড়াই ঘণ্টা হাঁ করে পড়েছিলেন। এর মধ্যে মুখে পিঁপড়া ঢুকেছে, কামড় দিয়ে তার জিহ্বা ফুলিয়ে ফেলেছে, তিনি নড়েন নি। কমল পত্নীর নাম লিজনা। একসময় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। অভিনেতা স্বামীর পেছনে সময় দিতে গিয় স্কুল ছেড়েছেন। এখন তাঁর প্রধান কাজ অভিনেতা স্বামীর কস্টিউম গুছিয়ে দেয়। এই দম্পতির একমাত্র কন্যা আরিয়ানার বয়স চার। পরীশিশুর চেয়েও সুন্দর। পুরো চায়না ট্রিপে আমার অনেকবারই ইচ্ছা করছে, মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করি। নিজের ছেলেমেয়ে ছাড়া অন্য কোনো ছেলেমেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করার আমার অভ্যাস নেই বলে করা হয় নি।