আমি করিমকে ডেকে বললাম, তুমি শাওনের অভিযোগের উত্তর গানে গানে দাও।
করিম সঙ্গে সঙ্গে গাইল—
সখী, বহে গেল বেলা, শুধু হাসিখেলা,
এ কি আর ভালো লাগে?
বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি, আগরতলার আনন্দময় ভ্রমণ শেষ করেই স্নিগ্ধ তার স্বামী এবং একমাত্র শিশুপুত্র রিসাদকে ফেলে অন্য এক পুরুষের সঙ্গে গৃহত্যাগ করে।
জগতের সর্বপ্রাণী সুখী হোক।
.
নীরমহল
ত্রিপুরার মহারাজ (খুব সম্ভব মহারাজ বীর বিক্রম বাহাদুর) তার স্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্যে স্ত্রীর দেশের রাজপ্রাসাদের অনুকরণে বিশাল এক জলপ্রাসাদ বানিয়েছিলেন। জলপ্রাসাদ, কারণ প্রাসদটা জলের মাঝখানে। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির মাঝখানে এক রাজবাড়ি। নাম নীরমহল। জলে যার ছায়া পড়ে। যেমন কল্পনা তেমন রূপ। UNESCO মনে হয় এর খোঁজ এখনো পায় নি। খোঁজ পেলে World Heritage-এর আওতায় অবশ্যই নিয়ে আসত।
আমরা একটি আনন্দময় রাত কাটালাম দূর থেকে নীরমহলের দিকে তাকিয়ে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল এমন একটা রেস্টহাউসে, যেখান থেকে জলপ্রসাদ নীরমহল দেখা যায়।
রাত অনেক হয়েছে, আমরা গোল হয়ে রেস্টহাউসের বারান্দায় বসে আছি। তাকিয়ে আছি নীরমহলের দিকে। চট করে রবীন্দ্রনাথের লাইন মনে হলো–
রাজশক্তি বসুকঠিন
সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লীন,
কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস
নিত্য-উচ্ছসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ,
এই তব মনে ছিল আশ।
কেন জানি মনটাই খারাপ হলো। আমি শাওনের দিকে ফিরে বললাম, গান শোনাও তো। একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে যাবে। Stop না বলা পর্যন্ত থামবে না।
রেস্টহাউসের সব বাতি নেভানো। আমাদের দৃষ্টি দূরের নীরমহলের দিকে। গায়িকার কিন্নর কণ্ঠ বাতাসে মিশে মিশে যাচ্ছে। সে গাইছে–’সখী, বহে গেল বেলা।‘
আমি মনে মনে বললাম, জলরাশির মাঝখানে অপূর্ব নীরমহল দেখার জন্যে আমি ত্রিপুরায় আসি নি। আমি এসেছি রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পদরেখার সন্ধানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আপনি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা গ্রহণ করুন। আমার গলায় সুর নেই। আপনার অপূর্ব সঙ্গীত আমি কোনোদিনই কণ্ঠে নিতে পারব না। আমার হয়ে আপনার গান আপনাকে পাঠাচ্ছে আমার স্ত্রী শাওন। কী সুন্দর করেই সে গাইছে-তাই-না কবি?
.
পরিশিষ্ট
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভগ্নহৃদয়’-এর কিছু অংশ
ভগ্নহৃদয়
প্রথম সর্গ
দৃশ–বন। চপলা ও মুরলা
চপলা। সখি, তুই হলি কি আপনা-হারা?
এ ভীষণ বনে পশি একেলা আছিস্ বসি
খুঁজে খুঁজে হোয়েছি যে সারা!
এমন আঁধার ঠাই-জনপ্রাণী কেহ নাই,
জুটিল-মস্তক বট চারি দিকে ঝুঁকি!
দুয়েকটি রবির সাহসে করিয়া ভর
অতি সন্তর্পণে যেন মারিতেছে উঁকি।
অন্ধকার, চারি দিক হতে, মুখপানে
এমন তাকায়ে রয়, বুকে বড় লাগে ভয়,
কি সাহসে রোয়েছিস্ বসিয়া এখানে?
মুরলা। সখি, বড় ভালবাসি এই ঠাই!
বায়ু বহে হুহু করি, পাতা কাপে ঝর ঝরি,
স্রোতস্বিনী কুলু কুলু করিছে সদাই!
বিছায়ে শুকনো পাতা বটমূলে রাখি মাথা
দিনরাত্রি পারি, সখি, শুনিতে ধ্বনি।
বুকের ভিতরে গিয়া কি যে উঠে উথলিয়া
বুঝয়ে বলিতে তাহা পারি না সজনি!
যা সখি, একটু মোরে রেখে দে একেলা,
এ বন আঁধার ঘোর ভাল লাগিবে না তোর,
তুই কুঞ্জবনে, সখি, কর গিয়ে খেলা!
চপলা। মনে আছে, অনিলের ফুলশয্যা আজ?
তুই হেথা বোসে রবি, কত আছে কাজ!
কত ভোরে উঠে বনে গেছি ছুটে,
মাধবীরে লোয়ে ডাকি,
ডালে ডালে যত ফুল ছিল ফুটে
একটি রাখি নি বাকি!
শিশিরে ভিজিয়ে গিয়েছে আঁচল,
কুসুমরেণুতে মাখা।
কাঁটা বিঁধে, সখি, হোয়েছিনু সারা
নোয়াতে গোলাপ-শাখা!
তুলেছি করবী গোলাপ-গরবী,
তুলেছি টগরগুলি,
যুঁইকুঁড়ি যত বিকেলে ফুটিবে
তখন আনিব তুলি।
আয়, সখি, আয়, ঘরে ফিরে আয়,
অনিলে দেখুসে আজ–
হরষের হাসি অধরে ধরে না,
কিছু যদি আছে লাজ!
মুরলা। আহা সখি, বড় তারা ভালবাসে দুই জনে।
মহান চীন এবং কিছু ড্রাগন
বিশেষ এক ধরনের জটিল ব্যাধি আছে যা শুধুমাত্র লেখকদের আক্রমণ করে। লেখকরা তাদের লেখালেখি জীবনে কয়েকবার এই ব্যাধিতে ধরাশায়ী হন। পৃথিবীতে এমন কোনো লেখক পাওয়া যাবে না-যিনি জীবনে একবারও এই জটিল অসুখের শিকার হন নি। মেটেরিয়া মেডিকায় এই অসুখের বিবরণ থাকা উচিত ছিল কিন্তু নেই লেখকদের নিয়ে কে ভাবে?
যাই হোক, অসুখটার ইংরেজি নাম ‘writer’s Block’, বাংলায় লেখক বন্ধ্যা রোগ বলা যেতে পারে। এই রোগের লক্ষণ এরকম-হঠাৎ কোনো একদিন লেখকের মাথা শূন্য হয়ে যায়। তিনি লিখতে পারেন না। গল্প-কবিতা দূরে থাকুক স্বরে ‘অ-ও না। তিনি অভ্যাসমতো রোজ কাগজ-কলম নিয়ে বসেন এবং কাগজের ধবধবে শাদা পাতার কোনায় কোনায় ফুল-লতাপাতা আঁকার চেষ্টা করেন। কাপের পর কাপ চা ও সিগারেট খান। একসময় উঠে পড়েন। এটা হচ্ছে রোগের প্রাথমিক পর্যায়।
রোগের দ্বিতীয় পর্যায়ে লেখক ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত হন। সারা রাত জেগে থাকেন। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। অকারণে রাগারাগি করতে থাকেন-যেমন, চা এত গরম কেন?’ [চা গরম হবারই কথা। লেখক আইসটি খেতে চাইলে ভিন্ন কথা।] ‘সবাই উঁচু গলায় কথা বলছে কেন?” [সবাই স্বাভাবিক গলাতেই কথা বলছে। এরচে নিচু গলায় কথা বললে কানাকানি করতে হয়। এই গ্লাসে করে আমাকে পানি কেন দেয়া হলো?’ [লেখক জীবনে কখনো কোন গ্লাসে পানি দেয়া হয়েছে তা নিয়ে মাথা ঘামান নি। ব্যাধিগ্রস্ত হবার পর গ্লা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। কী রকম গ্লাসে পানি দেয়া হলে তিনি খুশি হবেন তাও কিন্তু খোলসা করে বলছেন না।]