না।
এখন তুমি আর স্যার বলছ না। কেন? নিশ্চয়ই তুমি আমার উপর রাগ করেছ।
জ্বি-না স্যার।
মেজর সাহেব অনেকখানি ঝুঁকে এলেন আজিজ মাস্টারের দিকে। গলার স্বর নিচে নামিয়ে বললেন, শোন, ঐ মেয়েটির সঙ্গে আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আজ রাতে সম্ভব হবে না। আজ রাতে আমরা ব্যস্ত। কাল ভোরে। কি, তুমি খুশি তো?
আজিজ মাস্টার তাকিয়ে রইল।
কি, কথা বলছ না যে? বল, শুকরিয়া।
শুকরিয়া।
আমি কথার খেলাফ করি না। যা বলেছি তা করব। এখন তুমি আমার কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দাও।
মেজর সাহেব সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। নিজে একটি ধরালেন। তাঁর চোখে এখন আর হাসি ঝিকমিক করছে না।
তোমাদের এই জঙ্গলা-মাঠে কী আছে?
কিছু নাই। জঙ্গল।
আমরা জানি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশ কিছু জোয়ান এবং কয়েক জন। অফিসার এখানে লুকিয়ে আছে।
আজিজ মাস্টারের চোখ বড়-বড় হয়ে গেল।
ওরা আমাদের দু জন অফিসারকেও নিয়ে গেছে। এক জন হচ্ছে আমার বন্ধু মেজর বখতিয়ার। ফুটবল প্লেয়ার।
আমি কিছুই জানি না স্যার।
কিছুই জান না?
জ্বি-না স্যার।
আমি যত দূর জানি, এ-গ্রাম থেকেই তো ওদের খাবার যাচ্ছে।
আমি স্যার, কিছুই জানি না।
আমি ভাবছিলাম জান।
জানি না স্যার।
মেজর সাহেব চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানতে লাগলেন। প্রচণ্ড প্রস্রাবের বেগ হয়েছে আজিজ মাস্টারের। সে ভয়েভয়ে বলল, স্যার, আমি যাই?
মেজর সাহেব চোখ না-খুলেই বললেন, সেটা কি ঠিক হবে? আমরা ওদের ধরতে এসেছি। এখন তোমাকে যেতে দিলে খবরটা ওদের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। পারে না?
আজিজ মাস্টার ঢোক গিলল।
তুমি ঐ ঘরে আজ রাতটা কাটাও। আমরা অপারেশন শুরু করব বিকেলের দিকে। আরেকটি বড় কোম্পানি আসবে আমাকে সাহায্য করতে। ওদের জন্যেই অপেক্ষা। করছি।
আজিজ মাস্টারের হাঁপানির টান উঠে গেল। টেনে-টেনে শ্বাস নিতে লাগল। মেজর সাহেব হালকা গলায় বললেন, তোমাকে অনেক গোপন খবর দিয়ে দিলাম। তবে অসুবিধা নেই, তুমি বন্ধু-মানুষ। যাও, ঐ ঘরে চলে যাও।
স্যার, আমি কিছুই জানি না।
জান না—সে তো আগেই বলেছ। সবাই কি আর সব কিছু জানে? জানে না। যাও, ঐ ঘরে গিয়ে বসে থাক।
রোদ থেকে এসেছে বলেই কি না কে জানে, এত পরিচিত ঘরও আজিজ মাস্টারের কাছে অচেনা লাগতে লাগল। অথচ এটা টীচার্স রুম। আজিজ মাস্টার রোজ এখানে বসে।
মাস্টার সাব।
কে?
আজিজ মাস্টার অবাক হয়ে দেখল, একটা চেয়ারে ইমাম সাহেব জড়সড় হয়ে বসে আছেন। ইমাম সাহেবের নাক-মুখ ফুলে গেছে। নিচের ঠোঁটটি কেটে গেছে। তাঁর সাদা পাঞ্জাবিতে রক্তের ছোপ। কাটা ঠোঁট দিয়ে হলুদ রঙের রস বেরুচ্ছে। আজিজ মাস্টার দীর্ঘ সময় তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল এবং নিজের অজান্তেই এক সময় তার প্রস্রাব হয়ে গেল।
ইমাম সাহেব তাকিয়ে দেখলেন। মেঝেতে প্রস্রাব গড়াচ্ছে। তার কোনো ভাবান্তর হল না।
০৭.
দিনের বেলা মীর আলির কাজ হচ্ছে পরীবানুকে কোলে নিয়ে বারান্দায় বসে থাকা। পরীবানুর বয়স তিন। দাদাকে সে খুবই পছন্দ করে। মীর আলিও জগতের অনেক জটিল বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে। মীর আলির কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হওয়া। অস্বাভাবিক নয় যে সে পরীবানুর মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়।
আজ ভোরবেলাও সে নাতনীকে কোলে নিয়ে মুড়ি খেতে বসেছিল। দাঁত না থাকায় মুড়ি চিবোতে পারে না। একগাল মুড়ি নিয়ে তাকে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। ঘরে আম আছে। একটা পাকা আমের রস মুড়ির বাটিতে ঢেলে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়। অনুফা সেটা করবে না। যদি বাড়িতে না-থাকলে সে তার শ্বশুরের খাওয়াদাওয়ার দিকে তেমন নজর দেয় না।
আজ তার চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঘরে চায়ের পাতা আছে, গুড় আছে। বদি এনে রেখেছে। তার বাবার জন্যেই এনেছে। তিনি নিজের কানে শুনেছেন–বদি বলছে, বাজানরে মাঝেমধ্যে দিও। বুড়া মানুষ। চা-য় কাশির আরাম হয়।
মীর আলি প্রতিদিন ভোরেই বেশ সাড়ম্বরে খানিকক্ষণ কাশে, যাতে অনুফার চায়ের কথাটা মনে পড়ে। বেশির ভাগ দিনই তার মনে পড়ে না। আজও হয়তো পড়বে না। তবু সে কাশতে লাগল। কাশতে-কাশতেই পরীবানুকে বলল, চা হইল সর্দিকাশের বড়ো অষুধ। বুঝছস পরী?
পরী উত্তর দিল না।
বড় জামবাটির এক বাটি চা যদি সকালে খায় কেউ, তা হইলে সর্দিকাশি, বাত। সব যায়। চাটা খুব বড় অষুধ।
মীর আলির জন্যে আজ দিনটি সম্ভবত খুব শুভ। কারণ অনুফা তাকে এক বাটি চা এনে দিল। সেই চায়ে তেজপাতা দেওয়ায় বেশ সুন্দর একটা গন্ধ। অভিভূত হয়ে পড়ল মীর আলি।
মিষ্টি হইছে কি না দেখেন।
হইছে গো বেটি, হইছে। জবর বালা হইছে।
অনুফাকে দু-একটা সুন্দর-সুন্দর কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কী বললে সে। খুশি হয় তা মীর আলির জানা নেই।
মুড়ি চায়ের মইধ্যে ভিজাইয়া চামুচ দিয়া খান। চামুচ দিতাছি।
মীর আলি অনুফার প্রতি বড় মমতা বোধ করল। সংসারের আয়-উন্নতি যা হচ্ছে। এই মেয়েটির কারণেই হচ্ছে। ঘরে এখন চামচ আছে। নতুন সাইকেল আছে। গত বৎসর বদি তাকে লেপ বানিয়ে দিয়েছে। বলতে গেলে গত শীত কোন দিকে গিয়েছে বুঝতেই পারা যায় নি। অথচ বদিকে বিয়ে করানোর আগে কী হাল ছিল সংসারের। সব ভাগ্য। একেক জনের একেক রকম ভাগ্য। অনুফা এ-সংসারে ভাগ্য নিয়ে এসেছে। মীর আলি ভাবতে চেষ্টা করল, অনুফা এ-বাড়িতে আসার পর তারা কি কখনো এক বেলা না-খেয়ে থেকেছে? না। নীলগঞ্জের এ-রকম ভাগ্য কয় জনের আছে? অথচ কত ঝামেলা বদির বিয়েতে। শেষ মুহূর্তে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার অবস্থা। বদির মামা বলল, এই মেয়ের মা নাই। জামাইয়ের কোনো আদর হইত না। কথা খুবই সত্য। কিন্তু বিয়ের কথা ঠিকঠাক হবার পর বিয়ে ভেঙে দেওয়াটা ঠিক না। মনে খুতখুতানি নিয়ে সে ছেলে নিয়ে গেল। কী ঝড় বিয়ের রাত্রে! লণ্ডভণ্ড অবস্থা। দুপুররাতে ছেলে-বৌ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখল ঝড়ে গ্রামে কারোর কোনো ক্ষতি হয় নি, শুধু তার ঘরটি পড়ে গেছে। কী অলক্ষণ!