বুঝলে আজিজ, পাকিস্তানি মিলিটারির নামে আজগুবি সব গল্প ছড়ানো হচ্ছে। আমরা নাকি কোথায় কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে দুটি মুক্তিবাহিনীর ছেলেকে মেরেছি। গল্পটা তোমার বিশ্বাস হয়?
আজিজ মাস্টার জবাব দিল না। মেজর সাহেব অনেকটা সময় নিয়ে সিগারেট ধরালেন। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমরা কাঠুরে হলে সেটা করতাম। কিন্তু, আমরা কাঠুরে নই, আমরা সৈনিক। আমরা গুলি করে মারব। ঠিক না?
জ্বি স্যার।
হিন্দুস্থান বেতারে এসব প্রচার চালাচ্ছে, এবং অনেকেই এ-সব শুনছে। ঠিক? বল, ঠিক বলছি কি না।
জি-স্যার, ঠিক।
আচ্ছা, এ-গ্রামে ট্রানজিষ্টার আছে কার কার? তোমার আছে?
আজিজ মাস্টারের গলায় কফি আটকে গেল। তার আছে এবং সে স্বাধীন বাংলা বেতার শোনে।
কি, আছে?
জ্বি স্যার।
কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই শোন না।
মাঝে মাঝে শুনি স্যার।
শুনলেও নিশ্চয়ই বিশ্বাস কর না। ঠিক না?
মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয়।
আজিজ।
জ্বি স্যার।
তুমি একজন সৎলোক। অন্য কেউ হলে বলত বিশ্বাস হয় না। আমার মনে হয়। তুমি মিথ্যা একেবারেই বলতে পার না। আচ্ছা এখন বল, আর কার ট্রানজিস্টার আছে?
নীলু সেনের আছে। জয়নাল মিয়ার আছে।
ওরা কেমন লোক?
ভালো লোক স্যার। নির্বিরোধী মানুষ। এই গ্রামে খারাপ মানুষ কেউ নাই।
তাই নাকি?
জ্বি স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি যাও। ভয়ের কিছু নেই।
আজিজ মাস্টার উঠে দাঁড়াল। তার মনে হল, মেজর সাহেব একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
স্নামালিকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আজিজ মাস্টারের কেন যেন মনে হল এক্ষুণি তাকে আবার ডাকা হবে। সে এগোতে লাগল খুব সাবধানে। কিন্তু কেউ তাকে ডাকল না। প্রায় ত্রিশ গজের মতো যাওয়ার পর সে ভয়েভয়ে এক বার পেছনে তাকাল—মেজর সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার সঙ্গের রোগা লোকটিও চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে। আজিজ মাস্টারের বুক ধক করে উঠল। কেন উঠল কে জানে। এক বার পেছন ফিরে আবার মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া যায় না। আজিজ মাস্টার দ্বিতীয় বার বলল, স্লমালিকুম।
মেজর সাহেব তখন তাকে হাত ইশারা করে ডাকলেন। নীল শার্ট পরা লোকটি বলল, এই যে মাস্টার সাহেব, এদিকে আসেন ভাই। স্যার ডাকেন। আজিজ মাস্টার ফিরে এল। মেজর সাহেব হাসিমুখে বললেন, শুনলাম তুমি কবিতা লেখ। আজিজ মাস্টার বেকুবের মতো তাকাল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
এখানকার মসজিদের যে ইমাম সাহেব আছে, তার কাছে শুনলাম। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তুমি কি সত্যি কবিতা লেখ?
জ্বি স্যার।
বেশ। একটা কবিতা শোনাও। কবিতা আমি পছন্দ করি। শোনাও একটা কবিতা।
আজিজ মাস্টার তাকাল নীল শার্ট পরা লোকটির দিকে। সে শুকনো গলায় বলল, স্যার শোনাতে বলছে শোনান। চেয়ারে বসেন। বসে শোনান। ভয়ের কিছু নাই।
আজিজ মাস্টার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। মেজর সাহেব বললেন, বল, বল, সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। লেটেস্ট কবিতাটি বল। আজিজ মাস্টার যন্ত্রের মতো চার লাইন বলে গেল :
আজি এ নিশিথে তোমারে পড়িছে মনে
হৃদয়ে যাতনা উঠিছে জাগিয়া ক্ষণে ক্ষণে,
তুমি সুন্দর চেয়ে থাকি তাই কল্পলোকের চোখে
ভালবাসা ছাড়া নাই কিছু আর মোর মরুময় বুকে।
নীল শার্ট সেটি অনুবাদ করে দিল। মেজর সাহেব বললেন, এটিই তোমরা লেটেস্ট?
জ্বি স্যার।
ভালো হয়েছে। বেশ ভালো। তা মেয়েটি কে।
জ্বি স্যার?
কবিতার মেয়েটি কে? ওর নাম কি?
মালা।
মেয়েটি এখানেই থাকে?
আজিজ মাস্টার কপালের ঘাম মুছল। শুকনো গলায় বলল, এইখানেই থাকে।
তোমার স্ত্রী নাকি?।
জ্বি না স্যার। আমি বিয়ে করি নি।
এই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাও?
আজিজ মাস্টার ঢোক গিলল। বলে কী এই লোক!
কী, বল। চুপ করে আছ কেন? নাকি মেয়ের বাবা তোমার মতো বুড়োর কাছে। বিয়ে দিতে চায় না?
আজিজ মাস্টার খুকখুক করে কাশতে লাগল। নীল শার্ট তীক্ষ্ণ গলায় বলল, স্যারের কথার জবাব দেন। স্যার রেগে যাচ্ছেন।
মেজর সাহেব কৌতূহলী হয়ে তাকালেন। তাঁর চোখ দুটি খুশি-খুশি। বল, মেয়েটির বয়স কত?
বয়স কম।
কত?
তের-চোদ্দ।
তের-চোদ্দ বছরের মেয়েই তো ভালো। যত কম বয়স তত মজা।
আজিজ মাস্টার স্তম্ভিত হয়ে গেল। কী বলছে এসব।
মেয়েটির সঙ্গে তোমার যৌন সম্পর্ক আছে?
না।
মাথা নিচু করে আছ কেন?
মাথা তোল।
আজিজ মাস্টার মাথা তুলল।
মেয়েটির বুক কেমন আমাকে বল। আমি শুনেছি বাঙালি মেয়েদের বুক খুব সুন্দর, কথাটা কি ঠিক?
আমি জানি না।
জান না! বল কী! তুমি এখনো কোনো মেয়ের বুক দেখ নি?
আমি বিয়ে করি নি।
তাতে কী?
আজিজ মাষ্টারের কান ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল। বমি-বমি ভাব হল। মেজর সাহেব হঠাৎ সুর পাল্টে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটি কার? আই মিন ওর বাবার নাম কি? আজিজ মাস্টার জবাব দিল না! মেজর সাহেব অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, শুধু শুধু দেরি করছ, বলে ফেল। নীল শার্ট বলল, কেন শুধু শুধু রাগাচ্ছেন? বলে দেন না!
জয়নাল মিয়ার মেয়ে। উনার বড় মেয়ে।
যার বাড়িতে ট্রানজিস্টার আছে?
আজিজ মাস্টার বেশ অবাক হল। এই লোকটির স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। মনে রেখেছে।
তুমি এখন আর আগের মতো স্বতস্ফূর্তভাবে কথা বলছ না। প্রতিটি প্রশ্ন দু বার করে করতে হচ্ছে। কারণ কি?
আজিজ মাস্টার জবাব দিল না।
তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ! বল, রাগ করেছ?