তুমি জানলা ক্যামনে?
নান্দাইল রোডে হুনছি। সুন্নত না থাকলেই দুম। গুল্লি।
কও কী তুমি!
মিলিটারি মানুষ, রাগ বেশি। আমরার মতো না। রাগ উঠলেই দুম।
বদি একটি বিড়ি ধরিয়ে দ্রুত টানতে থাকে। তার মধুবনে যাওয়া অত্যন্ত দরকার। কে জানে হয়তো মধুবনেও মিলিটারি এসে দোকানপাট জ্বালিয়ে দিয়েছে। সে উঠে দাঁড়াল। মতি মিয়া বলল, যাও কই? বদি তার উত্তর না দিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করল। ইস্কুলঘরকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। হাঁটতে হবে অনেকটা পথ।
কড়া রোদ উঠছে। আকাশে মেঘের লেশমাত্র নেই। চারদিকে ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ। বদি হনহন করে ছুটছে।
০৬.
রোগা নীল শার্ট পরা লোকটি বাঙালি।
সে আজিজ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, ইনি মেজর এজাজ আহমেদ, ইনারে সালাম দেন। আজিজ মাস্টার যন্ত্রের মতো বলল, স্নামালিকুম। মেজর এজাজ পরিস্কার বাংলায় বললেন, আপনার নাম কি?
জ্বি, আমার নাম আজিজুর রহমান মল্লিক।
সে ইট এগেইন।
আজিজ মাস্টার নীল শার্ট পরা লোকটির দিকে তাকাল। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, নামটা আরেকবার বলেন। স্পষ্ট করে বলেন। গলায় জোর নাই?
আজিজ মাস্টার বলল, আজিজুর রহমান মল্লিক।
আপনি বসুন।
কোথায় বসতে বলছে? বসার দ্বিতীয় কোনো চেয়ার নেই। মাটিতে বসতে বলছে নাকি? আজিজ মাস্টারের গলা শুকিয়ে গেল। রোগা লোকটি স্কুলঘর থেকে একটি চেয়ার নিয়ে এল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, বসেন। স্যার বসতে বলেছেন, বসেন। আজিজ মাস্টার সঙ্কুচিত ভঙ্গিতে বসল। মেজর সাহেব দীর্ঘ সময় কোনো কথাবার্তা বললেন না। সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন আজিজ মাষ্টারের দিকে। আজিজ মাস্টার কাঁপা গলায় বলল, স্যার, ভালো আছেন? রোগা লোকটি বলল, শুনেন ভাই, আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবেন না। যা জিজ্ঞেস করবে শুধু তার জবাব দিবেন। ইনি লোক ভালো, ভয়ের কিছু নাই। স্যার বাংলা বলতে পারেন না, কিন্তু ভালো বুঝেন।
জ্বি আচ্ছা।
আপনার ভয়ের কিছু নাই। আরাম করে বসেন।
আজিজ মাস্টার আরাম করে বসার একটা ভঙ্গি করল। মেজর সাহেব একটা। সিগারেট ধরালেন। প্যাকেটটি বাড়িয়ে দিলেন আজিজ মাস্টারের দিকে। আণ্ডিও মাস্টার ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। রোগা লোকটি বলল, স্যার দিচ্ছেন যখন নেন। বললাম না—ইনি লোক ভালো। আজিজ মাস্টার একটা সিগারেট নিল। কী আশ্চর্য! মেজর সাহেব নিজে সিগারেটটি ধরিয়ে দিলেন। আজিজ মাস্টার তার ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেল। অত্যন্ত শরিফ আদমি।
পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল। মেজর সাহেব প্রশ্ন করলেন ইংরেজিতে, আজিজ মাস্টার জবাব দিল বাংলায়। কিছু প্রশ্ন আজিজ মাস্টার বুঝতে পারল না। নীল শার্ট পরা লোকটি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল।
তোমার নাম আজিজুর রহমান মল্লিক?
জ্বি স্যার।
মল্লিক মানে কি?
জানি না স্যার।
এই গ্রামে কত জন মানষ?
জানি না স্যার।
কত জন হিন্দু আছে?
জানি না স্যার।
তুমি দেখি কিছুই জান না!
স্যার, আমি বিদেশি মানুষ।
বিদেশি মানুষ মানে? তুমি পাকিস্তানি না?
জ্বি স্যার।
তাহলে তুমি বিদেশি হলে কীভাবে?
মেজর সাহেব চোখ বন্ধ করে জবাবের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। আজিজ মাস্টারের মাথায় কোনো জবাব এল না।
তুমি ইকবাল জিন্দাবাদ বলছিলে, ইকবাল কে?
কবি স্যার। বড়ো কবি। মহাকবি।
তুমি তার কবিতা পড়েছ? জ্বি-না স্যার।
পড় নাই—চীন ও আরব হামারা সারা জাঁহা হ্যায় হামরা?
জ্বি-না স্যার।
মেজর সাহেব আরেকটি সিগারেট ধরালেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। আজিজ মাস্টার লক্ষ করল লোকটিকে দূর থেকে যত অল্পবয়স্ক মনে হচ্ছিল আসলে তার বয়স তত অল্প নয়। চোখের নিচে কালি। কপালের চামড়ায় সূক্ষ্ম ভাঁজ। কত বয়স হতে পারে? পঁয়ত্রিশের কম নয়। আজিজ মাস্টারের বয়স আটত্রিশ। এই লোকটি তার য়ে তিন বছরের ছোট। অথচ এই লোকটির সামনে নিজেকে কেমন কেঁচোর মতো লাগছে।
মেজর সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। পা থেকে মোজা জোড়া টেনে খুলে ফেললেন। আবার প্রশ্ন-উত্তর শুরু হল।
এ-গ্রামে কোনো দুষ্ট লোক আছে?
জ্বি-না স্যার।
মুক্তিবাহিনী আছে?
জ্বি-না স্যার।
তুমি ঠিক জান?
জ্বি স্যার।
এই গ্রামের সবাইকে আমি চিনি।
তোমার ধারণা এই গ্রামে মুক্তিবাহিনী নেই?
জ্বি-না।
মেজর সাহেব মৃদু হাসলেন। কেন হাসলেন কে জানে। তিনি কি বিশ্বাস করছেন? আজিজ মাস্টার আবার বলল, মুক্তিবাহিনী নাই স্যার।
শেখ মুজিবের লোকজন আছে?
জ্বি-না স্যার।
তুমি জ্বি-না স্যার ছাড়া অন্য কিছু বলছ না কেন? তুমি কি ভয় পাচ্ছ? ভয় পাচ্ছি তুমি?
জ্বি-না স্যার।
গুড। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার দিকে ভালো করে তাকাও। কাও ভালো করে।
আজিজ মাষ্টার তাকাল। মেজর সাহেবের চোখ দুটি তার কাছে একটু নীলচে মনে হল। বিড়ালচোখো নাকি?
আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি খারাপ লোক?
জ্বি-না স্যার।
কফি খাবে?
আজিজ মাস্টার চোখ তুলে তাকাল। রোগা লোকটি বলল, খেতে চাইলে বলেন—খাব! আমার দিকে তাকান কেন? অভ্যাস না থাকলে বলেন—খাব না। ব্যস। বারবার আমার দিকে তাকাবেন না।
কি, কফি খাবে?
জি–না স্যার।
না কেন, খাও। কফি তৈরি হচ্ছে। তুমি কি কফির সঙ্গে ক্রীম খাও?
আজিজ মাষ্টার না-বুঝেই মাথা নাড়ল। কফি এসে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যে। অতি বিস্বাদ ডিনিস। আজিজ মাস্টার চুকচুক করে কফি খেতে লাগল। কাপ নামিয়ে রাখার সাহস হল না।