কায়দে আযম।
জিন্দাবাদ!!
লিয়াকত আলি খান!
জিন্দাবাদ!!
মহাকবি ইকবাল!
জিন্দাবাদ!!
রোদ উঠে গেছে
০৫.
রোদ উঠে গেছে।
বৈশাখ মাস—অল্প সময়েই রোদ ঝাঁঝাল হয়ে ওঠে।
ছোট্ট দলটি, যার নেতৃত্ব দিচ্ছে আজিজ মাস্টার, রোদে দাঁড়িয়ে ঘামছে। তাদের মুখ রক্তশূন্য। তারা বুকের মাঝে এক ধরনের কাঁপুনি অনুভব করছে।
রাস্তার ওপাশে চার-পাচটা জারুল গাছ। গাছের নিচে গেলে ছায়া পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে যাওয়া ঠিক হবে কি না আজিজ মাস্টার বুঝতে পারছে না। তারা জড়াজড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ধ্বনি দেয়। আড়চোখে মিলিটারিদের দিকে তাকায়। সরাসরি তাকাতে সাহসে কুলোয় না। সমস্ত বারান্দা জুড়ে মিলিটারিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কেউ বসে আছে। কেউ মাথার নিচে হাভারস্যাক দিয়ে ঘুমের মতো পড়ে আছে। পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে আসা দলটির প্রতি তাদের কোনো উৎসাহ দেখা গেল না। তাদের দৃষ্টি সন্ন্যাসীদের মতো নির্লিপ্ত। যেন জগতের কোনো কিছুতেই তাদের কিছু আসেযায় না।
পাকিস্তানের ফ্ল্যাগটি মতি মিয়ার হাতে। সে হাত উঁচু করে ফ্ল্যাগটি দোলাচ্ছিল—হাত ব্যথা হয়ে গেছে, কিন্তু নামাবার সাহস হচ্ছে না। আজিজ মাস্টার খুকখুক করে কয়েক বার কাশল। সেই শব্দে বারান্দায় বসা কয়েক জন তাকাল তার দিকে। আজিজ মাস্টার প্রাণপণে কাশি চাপতে চেষ্টা করল। সময় খারাপ। এ-রকম সময়ে কাউকে অযথা বিরক্ত করা ঠিক না। কিন্তু ক্রমাগত কাশি উঠছে। আজিজ মাস্টার লক্ষ করল উঠোনে চেয়ার পেতে যে-অফিসারটি বসে আছেন, তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে।
অত্যন্ত রূপবান একজন মানুষ। মিলিটারি পোশাকেও তাঁকে রাজপুত্রের মতো লাগছে। এঁর চোখে-মুখে কোনো ক্লান্তি নেই। তবে বসে থাকার ভঙ্গিটি শ্রান্তির ভঙ্গি। তিনি তাঁর সামনের টেবিলে পা তুলে দিয়েছেন। পায়ে খয়েরি রঙের মোজা। মানুষটি প্রকাণ্ড, তবে সেই তুলনায় পায়ের পাতা দুটি ছোট।
তাঁর কাছাকাছি যে-রোগা লোকটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখতে বাঙালিদের মতো লাগছে। তার গায়ে চকচকে নীল রঙের একটা শার্ট। এই লোকটি খুব ঘামছে। ময়লা একটা রুমালে ক্রমাগত ঘাড় মুছছে। অফিসারটি মৃদু স্বরে কী যেন বলল নীল শার্ট পরা লোকটিকে। নীল শার্ট তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আপনাদের মধ্যে হেডমাস্টার সাহেব কে?
আজিজ মাস্টারের বুকের মধ্যে শিরশির করতে লাগল।
কে আপনাদের মধ্যে হেডমাস্টার?
মতি মিয়া আজিজ মাস্টারের পিঠে মৃদু ধাক্কা দিল। আজিজ মাস্টার কাশির বেগ থামাতে-থামাতে বলল, জ্বি আমি।
আপনি থাকেন। অন্য সবাইকে যেতে বলেন। যান ভাই, আপনারা সবাই যান। ভয়ের কিছুই নাই।
আজিজ মাস্টার একা দাঁড়িয়ে রইল। অন্যরা মনে হল হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে তারা চলে গেল না। জুম্মাঘরের কাছে ছাতিম গাছের নিচে বসে রইল চুপচাপ। ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাস্টার ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছু পরিষ্কার হবে না।
মতি বিড়ি ধরিয়ে টানতে লাগল। সে জয়নাল মিয়ার সামনে বিড়ি খায় না। এই কথা তার মনে রইল না। সময়টা খারাপ। এই সময় কোনো কিছু মনে থাকে না। ছোট চৌধুরীও সিগারেট ধরালেন। তিনি সকাল থেকেই ঘামছেন।
মতি মিয়া বলল, ভয়ের কিছু নাই, কি কন?
নাহ্, ভয়ের কি? এরা বাঘও না, ভাল্লুকও না।
একেবারে খাঁটি কথা।
অন্যায় তো কিছু করি নাই। অন্যায় করলে একটা কথা আছিল।
একেবারে খাঁটি কথা। অতি লেহ্য কথা।
জয়নাল মিয়া উৎসাহিত বোধ করে। মতি বলল, নীলু চাচার বাড়িত যাই চলেন। কথাটা তার খুব মনে ধরে। কিন্তু আজিজ মাস্টার ফিরে না-আসা পর্যন্ত নড়তেও ইচ্ছে করে না। রোদ চড়তে শুরু করে। ছাতিম গাছের নিচে একটি দুটি করে মানুষ জমতে শুরু করে। সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ।
উত্তর বলে বোরো ধান পেকে আছে। কাটতে হবে। কিছু-কিছু জমিতে পাট দেওয়া হয়েছে। খেত নিড়ানির সময় এখন। দক্ষিণ বন্দে আউশ বোনা হবে। কিন্তু আজ মনে হয় এ-গ্রামের কেউ কোথাও যাবে না। আজকের দিনটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে সবাই অপেক্ষা করবে। এ-গ্রামে বহুদিন এ-রকম ঘটনা ঘটে নি।
বদিকে দেখা গেল ফর্সা জামা গায়ে দিয়ে হনহন করে আসছে। তার বগলে ছাতা। ছাতিম গাছের নিচে একসঙ্গে এতগুলি মানুষ দেখে হকচকিয়ে গেল।
বিষয় কি?
মতি মিয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, জান না কিছু?
কী জানুম?
আরে মুসিবত! জান লইয়া টানাটানি, আর—কিছুই জান না?
বদি চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকায়। কিছু বুঝতে পারে না। জয়নাল মিয়া ঠাণ্ডা গলায়। লে, গেরামে মিলিটারি আইছে।
এইটা কী বল? এইখানে মিলিটারি আইব ক্যান?
স্কুলঘরে গিয়া নিজের চউক্ষে দেখ। আজিজ মাস্টাররে রাইখ্যা দিছে।
এ্যাঁ!
আজ মধুবনে গিয়া কাম নাই, বাড়িত যাও।
বদি রাস্তার উপর বসে পড়ে। ফিসফিস করে বলে, কী সর্বনাশ!
জয়নাল মিয়া বিরক্ত হয়ে বলে, সর্বনাশের কী আছে? আমরা কী করলাম? কিছু করছি আমরা?
বদি মুখ লম্বা করে বসে থাকে। একসময় মৃদু স্বরে বলে, মুসলমানের জন্যে ভয়ের কিছুই নাই। এরা মুসলমানদের খুব খাতির করে। তবে পাক্কা মুসলমান হওয়া লাগে। চাইর কলমা জিজ্ঞেস করে।
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। চার কলেমা কারো জানা নেই। বদি উৎসাহিত হয়ে বলে, সুন্নত হইছে কি না এইটাও দেখে। কাপড় খুইলা দেখে।