নীল শার্ট পরা লোকটিও এগিয়ে আসছে তার দিকে। ব্যাপার কী? এ কে? তিনি অতি দ্রুত দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন, লাইলাহা ইল্লা আন্তা সোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজুয়ালেমিন। এই দোয়াটি খুব কাজের। হযরত ইউনুস আলায়হেস সালাম মাছের পেটে বসে এই দোয়া পড়েছিলেন।
নীল শার্ট পরা লোকটা এগিয়ে আসছে। কী চায় সে?
আপনি কে?
আমি এই গেরামের ইমাম।
আচ্ছালামু আইয়কুম ইমাম সাহেব।
ওয়ালাইকুম সালাম ওয়া রহমতুল্লাহ্।
আপনি একটু আসেন আমার সাথে।
কই যাইতাম?
আসেন। মেজর সাব আপনাকে ডাকেন। ভয়ের কিছু নেই। আসেন।
ইমাম সাহেব তিন বার ইয়া মুকাদ্দেমু পড়ে ডান পা আগে ফেললেন। সঙ্গের নীল শার্ট পরা লোকটি মৃদু স্বরে বলল, এত ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয়ের কিছুই নাই।
০৪.
আজিজ মাস্টারের অনিদ্রা রোগ আছে।
অনেক রাত পর্যন্ত তাকে জেগে থাকতে হয় বলেই অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমুতে হয়। আজ তাকে ভোরের আলো ফোটার আগেই জাগতে হল। কারণ স্কুলের দপ্তরি ও দারোয়ান রামমোহন প্রচন্ড শব্দে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে, এক্ষুণি আজিজ মাস্টারকে ঘর থেকে বের করতে হবে। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে আজিজ মাষ্টার কথা বলল, এই রাসমোহন, কী ব্যাপার?
আপনারে ডাকে, আপনারে ডাকে।
কে ডাকে?
মিলিটারি। গেরামে মিলিটারি আসছে। ইস্কুলঘরে।
কী বলছিস রাসমোহন?
আপনারে স্যার ডাকে।
আজিজ মাস্টার দরজা খুলে দেখল রাসমোহনের থুতনি বেয়ে ঘাম পড়ছে! গায়ের ফতুয়াটাও ঘামে ভেজা। স্কুল থেকে দৌড়ে এসেছে বোধহয়। শব্দ করে শ্বাস টানছে। রাসমোহন আবার বলল, মিলিটারি আপনারে ডাকে স্যার। আজিজ মাস্টার রাসমোহনের কথা মোটেও বিশ্বাস করল না। সময়টা খারাপ। খাকি পোশাকের একজন পিওন দেখলেও সবাই ভাবে পাঞ্জাবি মিলিটারি। রাসমোহনের রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়েছে। থানাওয়ালারা কেউ এসেছে কেন্দুয়া থেকে। খুব সম্ভব চিত্রা বুড়ির ছেলের ব্যাপারে। মাডার কেইসে পুলিশের খুব উৎসাহ। দল বেঁধে চলে আসে। নগদ বিদায়ের ব্যবস্থা আছে। এখানেও তাই হয়েছে। আজিজ মাস্টার অনেকখানি সময় নিয়ে হাত-মুখ ধুল। তার মাথায় চুল নেই, তবু যত্ন করে চুল আচড়াল। পরিষ্কার একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরুল। অর্ধেক পথ আসার পর তার মনে পড়ল, চাবি ফেলে এসেছে। আবার ফিরে গেল চাবি আনতে। বাড়ি ফিরবার পথে সত্যি-সত্যি বুঝল গ্রামে মিলিটারি এসেছে। তার স্মৃতি মিয়ার সঙ্গে দেখা হল। রশুন মাক্সির সঙ্গে দেখা হল। বাড়ি ঢোকার মুখে জয়নাল মিয়াকেও ছাতা মাথায় দিয়ে আসতে দেখা গেল। রাসমোহন এদের প্রত্যেককে এক বার এক বার করে তার অভিজ্ঞতার কথা বলল।
রাসমোহনের বর্ণনা মতো—সে স্কুলঘরের বারান্দায় ঘুমুচ্ছিল। তখনো চারদিক অন্ধকার। কে যেন তার পায়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মুখে টর্চের আলো ফেলল। সে উঠে বসে দেখে স্কুলে মিলিটারি গিজগিজ করছে।
জয়নাল মিয়া নিচু গলায় বলল, আন্দাজ কত জন হইব?
চাইর-পাঁচ শর কম না।
কও কী তুমি!
বেশিও হইতে পারে। সবটি মস্ত জোয়ান।
জোয়ান তো হইবই। মিলিটারি দুবলা-পাতলা হয় নাকি?
হাতে অস্ত্রপাতি আছে?
জয়নাল মিয়া বিরক্ত মুখে বলল, অস্ত্রপাতি তো থাকবই। এরা কি বিয়া করতে আইছে?
আজিজ মাস্টার গম্ভীর গলায় বলল, তারপর কী হয়েছে রাসমোহন?
তারা আমার নাম জিগাইল।
আজিজ মাস্টার বলল, কোন ভাষায়? উর্দু না ইংরেজি?
বাংলায়। পরিষ্কার জিগাইল—তোমার নাম কি? তুমি কে? কী কর?
তা কীভাবে হয়? এরা তো বাংলা জানে না।
আমি স্যার পরিষ্কার হুনলাম। নিজের কানে হুনলাম।
তারপর বল। তারপর কী হল?
আমি কইলাম—আমার নাম রাসমোহন। আমি স্কুলের দপ্তরি। তখন তারা কইল—হেডমাস্টাররে ডাইক্যা আন।
বাংলায় বলল?
জ্বি স্যার।
আরে কী যে বলে পাগল-ছাগলের মতো! এরা বাংলা জানে নাকি? কি শুনতে কি শুনেছ।
আজিজ একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে লক্ষ করল তার হাত কাঁপছে। এবং প্রস্রাবের বেগ হচ্ছে। খুব খারাপ লক্ষণ। এক্ষুণি হাঁপানির টান শুরু হবে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার হাঁপানির টান ওঠে। এখন সিগারেট খাওয়াটা ঠিক হবে না জেনেও আজিজ মাস্টার লম্বা-লম্বা টান দিতে শুরু করল। সে সাধারণত জয়নাল মিয়ার সামনে সিগারেট খায় না।
জয়নাল মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, তুমি যাও মাস্টার, বিষয়ডা কি জাইন্যা আস।
আমি, আমি কী জন্যে যাব?
আরে, ডাকতাছে তোমারে। তুমি যাইবা না তো যাইবটা কে?
আজিজ মাস্টারের সত্যি-সত্যি হাঁপানির টান উঠে গেল। সিগারেট ফেলে দিয়ে সে লম্বা-লম্বা শ্বাস নিতে শুরু করল। জয়নাল মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, এরা এইখানে থাকবার জন্যেই আসে নাই, বুঝলা? যাইতাছে অন্য কোনোখানে। ভয়ের কিছু নাই। একটা পাকিস্তানি পতাকা হাতে নিয়া যাও। একটা পতাকা আছে না? বাঁশের আগায় বান্ধ।
আমি একলা যাব? বলেন কী?
একসঙ্গে বেশি মানুষ যাওয়া ঠিক না।
ঠিক-বেঠিক যাই হোক, আমি একা যাব না।
এই রকম করতাছ কেন মাষ্টার? এরা বাঘও না, ভাল্লকও না।
একা যাব না। আপনারা চলেন আমার সাথে।
সকাল প্রায় সাতটার দিকে দু জনের একটি ছোট্ট দলকে একটি পাকিস্তানি ফ্লাগ হাতে নিয়ে ইস্কুলঘরের দিকে এগোতে দেখা গেল। রোগা আজিজ মাস্টার দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছে। সে ইস্কুলঘরের কাছাকাছি এসে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, পাকিস্তান! দলের অন্য সবাই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলল—জিন্দাবাদ!