মা কালী কিছু শোনেন কি না বলা মুশকিল। কিন্তু চিত্ৰা বুড়ির ধারণা, তিনি শোনেন এবং তিনি যে শুনছেন তার নমুনাও দেন। যেমন—এক রাত্রিতে খলখল হাসির শব্দ শোনা গেল। বুড়ির রক্ত জল হয়ে যাবার মতো অবস্থা। সে কাঁপা গলায় ডাকল, হেই মা, হেই গো নেংটা বেটি! হাসির শব্দ দ্বিতীয় বার আর শোনা গেল না। দেবীরা তালের মহিমা বারবার করে দেখাতে ভালবাসেন না।
চিত্রা বুড়ি আজ রাতেও মা কালীর সঙ্গে সুখদুঃখের অনেক কথা বলল। জোড়া পাঁঠার আশ্বাস দিয়ে ঘুমোতে গেল। তারপর জেগে উঠে চেঁচাল, কেলা যায় গো, লোকটা কে? কেউ জবাব দিল না, কিন্তু বুড়ির মনে হল অনেকগুলি মানুষ যেন এদিকে আসছে। শব্দ করে পা ফেলছে। হুঁ হাঁ হুঁ হাঁ এ-রকম একটা আওয়াজও আসছে। ডাকাত নাকি? চিত্রা বুড়ি ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। তার চোখের সামনে দিয়ে মিলিটারির দলটি পার হল। আলো কম। স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না।
চিত্ৰা বুড়ি কিছু বুঝতে পারল না। এরা কারা? এই রাতে কোত্থেকে এসেছে? বুড়ি দেখল, সেনবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েক বার টর্চের আলো ফেলল। তার মানে কি ডাকাত? কিন্তু সেনবাড়িতে ডাকাত আসার কথা নয়। সেনরা এখন হতদরিদ্র। এই বিশাল বাড়ির ইটগুলো ছাড়া ওদের আর কিছুই নেই।
ওরা আবার চলতে শুরু করেছে। জুম্মাঘরের কাছে এসে আবার সেনবাড়ির উপর টর্চের আলো ফেলল। কোন দিকে যাচ্ছে? কৈবর্তপাড়ার দিকে? ওদের আগেভাগে খবর নেওয়া দরকার। সেনবাড়ির পেছন দিক দিয়ে ছুটে গিয়ে খবর দেবে? চিত্ৰা বুড়ির কাছে সমস্ত ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে। এই রাতের বেলা দল বেঁধে এরা কেন আসবে?
না, কৈবর্তপাড়ার দিকে যাচ্ছে না। জুম্মাঘর পেছনে ফেলে এরা সড়কে উঠে গেল। টর্চের আলো এখন আর ফেলছে না। বুড়ির মনে হল এরা স্কুলঘরের দিকে যাচ্ছে। আজিজ মাস্টারকে খবর দেওয়া দরকার। কিন্তু তারও আগে খবর দেওয়া দরকার কৈবর্তপাড়ায়। বিপদের সময় নিজ গোত্রের মানুষের কথাই প্রথম মনে পড়ে।
চার-পাঁচটা কুকুর একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে। এরা কিছু টের পেয়েছে। কুকুর-বেড়াল অনেক কিছু আগেভাগে জানে। বুড়ি কালীমন্দিরের চাতাল থেকে নেমে এল। সে কোন দিকে যাবে মনস্থির করতে পারছে না।
গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে এটা প্রথম বুঝতে পারলেন নীলগঞ্জ মসজিদের ইমাম সাহেব। পাকা মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি সূরা ইয়াসিন পড়ছিলেন। আজান দেবার আগে তিনি তিন বার সূরা ইয়াসিন পড়েন। দ্বিতীয় বার পড়বার সময় অবাক হয়ে পুরো দলটাকে দেখলেন। এরা স্কুলঘরের দিকে যাচ্ছে।
প্রথম কয়েক মুহূর্ত তিনি ব্যাপারটা বুঝতেই পারলেন না। সূরা ইয়াসিন শেষ করে দীর্ঘ সময় মসজিদের সিঁড়িতে বসে রইলেন। অন্ধকার এখনো কাটে নি। পাখপাখালি ডাকছে। ইমাম সাহেব মনস্থির করতে পারছেন না—এখানে বসে থাকবেন, না খবর দেওয়ার জন্যে ছুটে যাবেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর মনে হল সিড়িতে এ-রকম প্রকাশ্যে বসে থাকা ঠিক না। মসজিদের ভেতরে থাকা দরকার। কিন্তু নীল গঞ্জের মসজিদে তিনি কখনো একা ঢোকেন না। এই মসজিদে জীন নামাজ পড়ে—এ-রকম একটা প্রবাদ আছে। অনেকেই দেখেছে। তিনি অবিশ্যি এখনো দেখেন নি। কিন্তু তাঁর ভয় করে।
একা বসে থাকতে থাকতে তাঁর মনে হল, এই যে তিনি দেখলেন একদল মিলিটারি, এটা চোখের ভুল নয় তো? নান্দাইল রোডে মিলিটারি আসে নি, সোহাগীতে আসে নি—এখানে আসবে কেন? এখানে আছেটা কী? নেহায়েতই গণ্ডগ্রাম।
ইমাম সাহেব ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। স্কুলঘর বাশবনের আড়ালে পড়েছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মুসল্লিরা কেউ আসছে না কেন? নাকি মিলিটারির খবর জেনে গেছে সবাই? তাঁর প্রবল ইচ্ছে হতে লাগল নামাজ না-পড়েই ঘরে ফিরে যেতে। আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে, অথচ কারো দেখা নেই।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করবার পর মতি মিয়াকে আসতে দেখা গেল। মতি মিয়া একটা মামলায় জড়িয়ে ইদানীং ধর্মেকর্মে অতিরিক্ত রকমের উৎসাহী হয়ে পড়েছে। ইমাম সাহেব নিচু গলায় বললেন, এই মতি, কিছু দেখলা?
কী দেখুম? কিসের কথা কন?
কিছু দেখ নাই?
নাহ। বিষয়ডা কী?
ইমাম সাহেব আর কিছু না-বলে চিন্তিত ভঙ্গিতে আজান দিতে গেলেন। আজান শেষ করে মতি মিয়াকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ইস্কুলঘরের কাছে কিছুই দেখ নাই?
নাহ্। ব্যাপার কি ভাইঙ্গা কন
মনে হয় গেরামে মিলিটারি ঢুকছে।
কী ঢুকছে?
মিলিটারি।
আরে কী কন? এই গেরামে মিলিটারি আইব ক্যান?
আমি যাইতে দেখলাম।
চউক্ষের ধান্ধা। আন্ধাইরে কি দেখতে কি দেখছেন। নান্দাইল রোডে তো এখন তক মিলিটারি আসে নাই।
তুমি জানলা ক্যামনে?
আমার শালা আইছে গতকাইল। নেজামের বড় ভাই।
আমি কিন্তু নিজের চউক্ষে দেখলাম।
আরে না। মিলিটারি আইলে এতক্ষণে গুলি শুরু হইয়া যাইত। মিলিটারি কি সোজা জিনিস?
ইমাম সাহেব নামাজ শুরু করবার আগেই আরো তিন জন নামাজী এস পড়ল। তারাও কিছু জানে না। এক জন এসেছে স্কুলঘরের সামনে দিয়ে, সেও কিছু দেখে নি।
ইমাম সাহেব আজ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে সাধারণত তিনি হাদিস-কোরানের দুই-একটি কথা বলেন। আজ কিছুই বললেন না। বাড়ির দিকে রওনা হলেন। বেশ আলো চারদিকে, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। জোড়া শিমুল গাছের কাছে এসে তিনি আড়চোখে স্কুলঘরের দিকে তাকালেন। বারান্দায় সারি-সারি সৈন্য বসে আছে। ইমাম সাহেবের মনে হল স্কুল কম্পাউন্ডের গেটের কাছে দাঁড়ানো একটা লোক হাত ইশারা করে তাঁকে ডাকছে। লোকটির পরনে ফুল প্যান্ট এবং নীল রঙের একটা হাফ শার্ট। কিন্তু তাঁকে ডাকছে কেন? নাকি তিনি ভুল দেখছেন। ইমাম সাহেবের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমল। তিনি এক বার আয়াতুল কুর্সি ও তিন বার দোয়া ইউনুস পড়ে স্কুলঘরের দিকে এগুলেন।