পারছি।
ভয় লাগছে?
না।
ওরা কি ঝড়ের সময় পালিয়েছে?
হ্যাঁ। এতক্ষণে ওরা অনেক দূর চলে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি মধুবনের দিকে গেলে হয়তো এখনো ওদের ধরা যাবে।
তুমি আবার আমাকে কনফিউজ করতে চেষ্টা করছ। এরা হয়তো বনেই বসে আছে।
রফিক মৃদু হাসল।
বল, ওরা কি বনে বসে আছে?
হয়তো আছে। গভীর রাতে বের হয়ে আসবে।
ঠিক করে বল।
আপনি এখন আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করবেন না। কাজেই কেন শুধু শুধু প্রশ্ন করছেন?
কৈবর্তপাড়ায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। চিত্রা বুড়ি অবাক হয়ে আগুন দেখছে। রাজাকাররা ছোটাছুটি করছে। তাদের ছোটাছুটি দেখে মনে হয় খুব উৎসাহ বোধ করছে। আগুন জ্বালানোর জন্যে তাদের যথেষ্ট খাটাখাটনি করতে হচ্ছে। ভেজা ঘরবাড়ি। আগুন সহজে ধরতে চায় না।
মীর আলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আগুন আগুন বলে চিৎকার করছে। সে চোখে দেখতে পায় না। কিন্তু আগুন দেখতে পাচ্ছে। গ্রামের মানুষজন সব বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে।
১৬.
মেজর এজাজ আহমেদ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পাশে ডান দিকে, চাইনীজ রাইফেল হাতে দুজন জোয়ান এসে দাঁড়িয়েছে। রফিক নেমেছে বিলে।
বিলের পানি অসম্ভব ঠাণ্ডা। রফিক পানি কেটে এগোচ্ছে। কী যেন ঠেকল হাতে। মনার ছোট ভাই বিরু। উপুড় হয়ে ভাসছে। যেন ভয় পেয়ে কাছে এগিয়ে আসতে চায়। রফিক পরম স্নেহে বিরুর গায়ে হাত রেখে বলল, ভয় নাই। ভয়ের কিছুই নাই।
পাড়ে বসে থাকা মেজর সাহেব বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছ রফিক।
নিজের সঙ্গে মেজর সাহেব।
কী বলছ নিজেকে?
সাহস দিচ্ছি। আমি মানুষটা ভীতু।
রফিক।
বলুন।
ওরা কি বন ছেড়ে চলে গেছে? সত্যি করে বল।
রফিক বেশ শব্দ করেই হেসে উঠল। আচমকা হাসির শব্দে মেজর সাহেব চমকে উঠলেন।
কৈবর্তপাড়ায় আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। আলো হয়ে উঠছে চারদিক। রফিককে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এবার। ছোটখাটো অসহায় মানুষ বুকপানিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেজর সাহেব বললেন, রফিক, তুমি কি বেঁচে থাকতে চাও?
রফিক শান্ত স্বরে বলল, চাই মেজর সাহেব। সবাই বেঁচে থাকতে চায়। আপনি নিজেও চান চান না?
মেজর সাহেব চুপ করে রইলেন। রফিক তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, মেজর সাহেব, আমার কিন্তু মনে হয় না আপনি জীবিত ফিরে যাবেন এ-দেশ থেকে।
মেজর এজাজ আহমেদ সিগারেট ধরালেন, কৈবর্তপাড়ার আগুনের দিকে তাকালেন। পশতু ভাষায় সঙ্গের জোয়ান দুটিকে কী যেন বললেন। গুলির নির্দেশ হয়তো। রফিক বুঝতে পারল না। সে পশতু জানে না।
হ্যাঁ, গুলির নির্দেশই হবে। সৈন্য দুটি বন্দুক তুলছে। রফিক অপেক্ষা করতে লাগল।
বুক পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে লালচে আগুনের আঁচে যে-রফিক দাঁড়িয়ে আছে, মেজর এজাজ আহমেদ তাকে চিনতে পারলেন না। এ অন্য রফিক। মেজর এজাজের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।