জ্বি স্যার।
ও তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।
জয়নাল মিয়া হতভম্ব হয়ে তাকাল।
কিন্তু ওর যন্ত্রপাতি বেশি ভালো বলে মনে হচ্ছে না। আমার মনে হয় ভয় পেয়ে ওটার এই অবস্থা। আমি নিশ্চিত, উত্তেজিত অবস্থায় এটা আরো ইঞ্চিখানেক বড় হবে। কি বল জয়নাল?
জয়নালের পা কাঁপতে লাগল—এসব কী শুনছে?
তবে আমি ঐ যন্ত্রটার জন্যে একটা একসারসাইজের ব্যবস্থা করেছি। আমি ঠিক করেছি ওখানে একটা ইট ঝুলিয়ে দেব। এতে এটা আরো কিছু লম্বা হবে বলে মনে হয়।
ইমাম সাহেব অস্ফুট একটি ধ্বনি করলেন। মেজর সাহেব বললেন, কিছু বলবে ইমাম?
জ্বি-না স্যার।
জয়নাল, তুমি কিছু বলবে? জ্বি-না।
আমি ঠিক করেছি মাস্টারকে এই অবস্থায় তোমার মেয়ের কাছে নিয়ে যাব। জিজ্ঞেস করব এই সাইজে ওর চলবে কি না। জয়নাল, তোমার মেয়েটি কি বাড়িতে আছে?
জয়নাল মিয়া মাটিতে বসে পড়ল। মেজর সাহেব হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন। যেন কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। ঘরে একটি শব্দও হল না।
জয়নাল।
জ্বি।
তোমার মেয়েটি বাড়িতেই আছে আশা করি।
জয়নাল মিয়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মেজর সাহেব প্রচণ্ড ধমক দিলেন, কান্না বন্ধ কর। কান্না আমার সহ্য হয় না। চল যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল চল।
আজিজ মাষ্টার তখন কথা বলল। অত্যন্ত স্পষ্ট স্বরে বলল, মেজর সাহেব, আমি মরবার জন্যে প্রস্তুত আছি। আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচান।
মেজর সাহেব মনে হল বেশ অবাক হলেন। কৌতূহলী গলায় বললেন, মরতে রাজি আছ?
হ্যাঁ।
ভয় লাগছে না?
লাগছে।
তবু মরতে চাও?
আজিজ মাস্টার জবাব না দিয়ে নিচু হয়ে তার পায়জামা তুলে পরতে শুরু করল। মেজর সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করতে লাগলেন। কিছুই বললেন না।
আজিজ মাস্টারকে তার প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে রাজাকাররা নিয়ে গেল বিলের দিকে। আজিজ মাস্টার বেশ সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে গেল। যাবার আগে ইমাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, স্নামালিকুম। ইমাম সাহেব বা জয়নাল মিয়া কেউ কিছু বলল না।
আজিজ মাস্টার চলে যাবার পর দীর্ঘ সময় কেউ কোনো কথা বলল না। মেজর সাহেব গম্ভীর মুখে সিগারেট টানতে লাগলেন। জয়নাল মিয়া কাঁপতে লাগল থরথর করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলঘরের পেছনে কয়েকটি গুলির শব্দ হল। ইমাম সাহেব ক্রমাগত দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন।
মেজর সাহেব বললেন, জয়নাল, তুমি আমার প্রশ্নের ঠিক-ঠিক জবাব দাও। আমাকে রাগিও না। বল, মোট কত জন সৈন্য লুকিয়ে আছে তোমাদের জঙ্গলা মাঠে? মনে রাখবে আমি একই প্রশ্ন দু বার করব না। বল কত জন?
প্রায় এক শ।
ইমাম সাহেব চোখ বড়-বড় করে তাকালেন। রফিক অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। মেজর সাহেব সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরাতে গিয়ে তাঁর হাত কাঁপতে লাগল।
এরা কবে এসেছে এই বনে?
পরশু।
এই গ্রাম থেকে তোমরা ক বার খাবার পাঠিয়েছ?
তিন বার।
আজিজ মাস্টার এবং ইমাম এরা এ-খবর জানে?
জ্বি-না, এরা বিদেশি মানুষ। এদের কেউ বলে নাই।
ঐ সৈন্যরা এখান থেকে কোথায় যাবে জান?
জ্বি-না।
কেউ জানে? জ্বি-না।
ওদের মধ্যে কত জন অফিসার আছে?
আমি জানি না।
ওদের সঙ্গে গোলাবারুদ কী পরিমাণ আছে?
জানি না স্যার।
ওদের মধ্যে আহত কেউ আছে?
আছে। কত জন?
ছয়-সাত জন।
ওরাও বনেই আছে?
জ্বি-না।
ওরা কোথায়?
কৈবর্তপাড়ায়। জেলেপাড়ায়।
বনে খাবার নিয়ে কারা যেত?
কৈবর্তরা।
মেজর সাহেব থামলেন। জয়নাল মিয়া মাটিতে বসে হাঁপাতে লাগল। রফিক এখনো জানালার দিয়ে তাকিয়ে আছে। মেজর সাহেব বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও।
জ্বি স্যার?
তুমি যাও। তোমাকে যেতে বললাম।
জয়নাল মিয়া নড়ল না। উবু হয়ে বসে রইল। মেজর সাহেব বললেন, নাকি যেতে চাও না?
যেতে চাই।
তাহলে যাও। দৌড়াও। আমি মত বদলে ফেলার আগেই দৌড়াও।
জয়নাল মিয়া উঠে দাঁড়াল। নিচু হয়ে বলল, স্যার, স্লামালিকুম।
মেজর সাহেব বললেন, ইমাম, তুমিও যাও।
ইমাম সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
যাও, যাও। চলে যাও। কুইক।
ওরা ঘর থেকে বেরুল। স্কুলগেট পার হয়েই ছুটতে শুরু করল। মেজর সাহেব জানালা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মুখ অত্যন্ত গম্ভীর।
রফিক!
জ্বি স্যার?
জয়নাল কি সত্যি কথা বলল?
মনে হয় না স্যার। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে অনেক সময় এ-জাতীয় কথা বলা হয়।
কিন্তু আমি জানি, ও সত্যি কথাই বলেছে।
রফিক চুপ করে রইল।
এবং আমার মনে হচ্ছে তুমিও তা জান।
রফিক তাকাল জানালার দিকে। বাইরে ঘন অন্ধকার।
আমার মনে হয় তুমি আরো অনেক কিছুই জান।
আমি তেমন কিছু জানি না।
তুমি শুধু বল, তোমাদের সৈন্যরা এখনো কি বনে লুকিয়ে আছে?
আমি কী করে জানব?
তুমি অনেক কিছুই জান। আমি কৈবর্তপাড়ায় তল্লাশি করতে চেয়েছিলাম, তুমি বলেছিলে—প্রযোজন নেই।
আমার ভুল হয়েছিল। সবাই ভুল করে।
ঝড়ের সময় একটা পাগল ছুটে গেল বনের ভেতর। যায় নি?
হ্যাঁ।
ওকে বনের ভেতর যেতে দেখে তুমি উল্লসিত হয়ে উঠলে।
রফিক একটি নিঃশ্বাস ফেলল।
বল, তুমি উল্লসিত হও নি?
ভুল দেখেছেন স্যার।
আমার ধারণা, ঐ পাগলটি বনে খবর নিয়ে গেছে। এবং সবাই পালিয়েছে ঝড়ের সময়।
মেজর সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন কণ্ঠে বললেন, চল আমার সঙ্গে।
কোথায়?
বুঝতে পারছ না কোথায়? তুমি তো বুদ্ধিমান, তোমার তো বুঝতে পারা উচিত। বল, বুঝতে পারছ?