মীর আলি খুনখুন করে কাঁদে।
ভাতের জন্যে কাঁদে। বদিউজ্জামান বাড়ি ফেরে নি। সে না-ফেরা পর্যন্ত অনুফা ভাত চড়াবে না। ঘরে চাল-ডাল সবই আছে। চারটা চাল ফোটাতে এমন কি ঝামেলা মীর আলি বুঝতে পারে না। অনেক রকম ঝামেলা আছে ঠিকই—মাথার উপর টিনের ছাদ নেই। গ্রামে মিলিটারি মানুষ মারছে। তাই বলে মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণা তো চলে যায় নি? পরীবানুও বিরক্ত করছে না। ঘুমাচ্ছে। অসুবিধা তো কিছু নেই।
মীর আলি মৃদু স্বরে বলল, বৌ, চাইরডা ভাত রাইন্ধা ফেল। অনুফা তীব্র স্বরে বলল, আপনে মানুষ না আর কিছু?
মীর আলি অবাক হয়ে বলে, আমি কী করলাম।
পনের-বিশ জন সেপাই বসে আছে স্কুলের বারান্দায়। এরাও ক্ষুধার্ত, সমস্ত দিন কোনো খাওয়া হয় নি। ওদের জন্যে রান্না হবার কথা মধুবনে। ঝড়ের জন্যে নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা হয়েছে। রান্না-করা খাবার এসে পৌঁছায় নি। কখন এসে পৌঁছাবে কে জানে? এরা সবাই দেয়ালে ঠেস দিয়ে শান্তি ভঙ্গিতে বসে আছে। কয়েক জন স্পষ্টতই ঘুমাচ্ছে। কিছু বাঙালি রাজাকার ওদের সঙ্গে গল্প জমাবার চেষ্টা করছে। গল্প জমছে না। ওরা হাল ছাড়ছে না, ওস্তাদজী ওস্তাদজী বলেই যাচ্ছে।
বদিউজ্জামানের মনে হল জ্বর এসেছে। সে নিশ্চিত হতে পারছে না। মাথায় হাত দিলে কোনো উত্তাপ পাওয়া যায় না। কিন্তু তার কান ঝাঁঝাঁ করছে। কিছুক্ষণ আগেও তার শীত করছিল। এখন আর করছে না। খুকখুক করে কে যেন কাশল। নাকি সে নিজেই কাশছে? নিজামের মতো তারও কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? একবার মনে হল শীতল। ও লম্বা একটা কি যেন তার শার্টের ভেতর ঢুকে গেছে। সে প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু চিৎকার করল না। মনের ভুল। শার্টের ভেতর কিছুই নেই। বুদিউজ্জামানের মনে হল সে যেন অনেকের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে। কথাবার্তা বলতে বলতে কারা যেন এগিয়ে আসছে। এটাও কি মনের ভুল? বদিউজ্জামান উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। সে ঠিক করে রাখল মিলিটারিরা তাকে মেরে ফেললে সে বলবে, ভাইয়েরা কেমন আছেন? বড় মজার ব্যাপার হবে। বদিউজ্জামান নিজের মনে খুকখুক করে হাসতে লাগল। বাঁ দিকে চারটা সবুজ চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে শেয়াল। দিনে যে-শেয়ালটা তাকে দেখে গিয়েছিল সে নিশ্চয়ই তার স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এসেছে। ভাবতে বেশ মজা লাগল বদিউজ্জামানের। সে আবার হাসতে শুরু করল। এবার আর নিজের মনে হাসা নয়, শব্দ করে হাসা।
১৫.
রফিক বাইরে এসে দেখল, মেজর সাহেব স্কুলঘরের শেষ প্রান্তের বারান্দায় একাকী দাঁড়িয়ে আছেন। রফিককে দেখে তিনি কিছুই বললেন না। রফিক বারান্দায় নেমে গেল। অপেক্ষা করল খানিকক্ষণ, তারপর হাঁটতে শুরু করল গেটের দিকে। মেজর সাহেব ভারি গলায় ডাকলেন. রফিক।
রফিক ফিরে এল।
কোথায় যাচ্ছিলে?
তেমন কোথাও না?
তোমাকে একটা কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি।
বলুন।
তুমি কি জান আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না?
জানি।
কখন থেকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি জান?
শুরু থেকেই। কোনো বাঙালিকেই আপনি বিশ্বাস করেন না।
তা ঠিক। যারা বিশ্বাস করেছে, সবাই মারা পড়েছে। আমার বন্ধু মেজর বখতিয়ার বিশ্বাস করেছিল। ওরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে।
মেজর বখতিয়ার বিশ্বাস করেছিল কি করে নি—সেটা আপনি জানেন না। অনুমান করছেন।
হ্যাঁ, তাও ঠিক। আমি জানি না।
মেজর সাহেব হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ঐ মাস্টারটির বিশেষ অঙ্গে ইট ঝুলিয়ে দিয়েছ?
না।
কেন? প্রমাণ সাইজের ইট পাও নি?
রফিক কথা বলল না। মেজর সাহেব চাপা স্বরে বললেন, বাঙালি ভাইদের প্রতি দরদ উথলে উঠেছে?
আমার মধ্যে দরদটরদ কিছু নেই মেজর সাহেব। ইট ঝোলানোটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে।
মোটেই অপ্রয়োজনীয় নয়। আমি ইট-বাঁধা অবস্থায় ওকে ওর প্রেমিকার কাছে নিয়ে যাব। এবং ওকে বলব সেই প্রেমের কবিতাটি আবৃত্তি করতে।
কেন?
রফিক।
জ্বি স্যার।
তুমি আমাকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস কোথায় পেলে?
আপনি একজন সাহসী মানুষ। সাহসী মানুষের সঙ্গে থেকে-থেকে আমিও সাহসী হয়ে উঠেছি।
আই সি।
এবং স্যার, আপনি এক বার আমাকে বলেছিলেন—আমার মনে কোনো প্রশ্ন থাকলে তা বলে ফেলতে।
বলেছিলাম?
জ্বি স্যার।
সেই প্রিভিলেজ এখন আর তোমাকে দিতে চাই না। এখন থেকে তুমি কোনো প্রশ্ন করবে না।
ঠিক আছে স্যার।
রফিক।
জ্বি স্যার। আজ তোমাকে অস্বাভাবিক রকম উৎফুল্ল লাগছে।
আপনি ভুল করছেন সার। আমাকে উৎফুল্ল দেখানোর কোনো কারণ নেই। এমন কিছু ঘটে নি যে আমি উৎফুল্ল হব।
তুমি বলতে চাও যে বিমর্ষ হবার মতো অনেক কিছু ঘটেছে?
আমি তাও বলতে চাই না।
মেজর সাহেব পশতু ভাষায় কি যেন বললেন। কোনো কবিতাটবিতা হবে হয়তো। রফিক তাকিয়ে রইল। মেজর সাহেব বললেন, রফিক, তুমি পশতু জান?
জ্বি-না স্যার।
না চাইলেও শোন। এর মানে হচ্ছে—বেশি রকম বুদ্ধিমানদের মাঝে-মাঝে বড় রকম বোকামি করতে হয়।
রফিক কিছুই বলল না। মেজর সাহেব বললেন, চল, জয়নাল লোকটির কাছ থেকে কিছু জানতে চেষ্টা করি। তোমার কি মনে হয় ও আমাদের কিছু বলবে?
না স্যার, বলবে না।
কি করে বুঝলে?
এরা কিছুই জানে না। কাজেই কিছু বলার প্রশ্ন ওঠে না।
চল দেখা যাক।
তোমার নাম জয়নাল?
জ্বি।
এই নেংটা মানুষটাকে তুমি চেন?