জ্বি স্যার।
এই মিথ্যাবাদী কুকুরটাকে নেংটো করে সমস্ত গ্রামে ঘুরে-ঘুরে দেখাবে। বুঝতে পারছ?
পারছি।
আর শোন, একটা ইটের টুকরো ওর পুরুষাঙ্গে ঝুলিয়ে দেবে। এতে সমস্ত ব্যাপারটায় একটা হিউমার আসবে।
আজিজ মাস্টার কাঁপা গলায় বলল, আমি কিছুই জানি না স্যার। একটা কোরান শরিফ দেন, কোরান শরিফ ছুঁয়ে বলব।
তার কোনো প্রয়োজন দেখি না। রফিক, যা করতে বলছি কর।
রফিক থেমে থেমে বলল, মানুষকে এভাবে লজ্জা দেবার কোনো অর্থ হয় না। মেজর সাহেবের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হতে থাকল। তিনি তাকিয়ে আছেন রফিকের দিকে। রফিক বলল, আপনি যদি একে অপরাধী মনে করেন তাহলে মেরে ফেলেন। লজ্জা দেবার দরকার কি?
তুমি একে অপরাধী মনে কর না?
না। আমার মনে হয় সে কিছু জানে না।
সে এই গ্রামে থাকে আর এত বড় একটা ব্যাপার জানবে না?
জানলে বলত। কিছু জানে না, তাই বলছে না।
বলবে সে ঠিকই। ইট বেঁধে তাকে বাড়ি-বাড়ি নিয়ে যাও—দেখবে তার মুখে কথা ফুটেছে। তখন সে প্রচুর কথা বলবে।
রফিক ঠাণ্ডা স্বরে বলল, স্যার, ওকে এ-রকম লজ্জা দেয়াটা ঠিক না।
কেন ঠিক না?
আপনি শুধু ওকে লজ্জা দিচ্ছেন না, আপনি আমাকেও লজ্জা দিচ্ছেন। আমিও ওর মতো বাঙালি।
তাই নাকি! আমি তো জানতাম তুমি পাকিস্তানি? তুমি কি সত্যি পাকিস্তানি?
জ্বি স্যার।
আমার মনে হয় এটা তোমার সব সময় মনে থাকে না। মনে রাখবে।
জ্বি স্যার, রাখব।
এটা তোমার নিজের স্বার্থেই মনে রাখা উচিত।
রফিক চুপ করে গেল। মেজর সাহেব বললেন, একটা মজার ব্যাপার কি জান রফিক? তুমি যদি আজিজ মাস্টারকে চয়েস দাও মৃত্যু অথবা লজ্জাজনক শাস্তি—তাহলে সে লজ্জাজনক শাস্তিটাই বেছে নেবে। মহানন্দে পুরুষাঙ্গে ইট বেঁধে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াবে। জিজ্ঞেস করে দেখ।
রফিক কিছুই জিজ্ঞেস করল না। মেজর সাহেব কঠিন স্বরে বললেন, আজিজ, পরিষ্কার উত্তর দাও। মরতে চাও, না চাও না? আমি দ্বিতীয় বার এই প্রশ্ন করব না। ত্রিশ সেকেণ্ডের ভেতরে জবাব চাই। বল, মরতে চাও, না চাও না?
মরতে চাই না।
মেজর সাহেব হাসিমুখে বললেন, বেশ, তাহলে কাপড় খুলে ফেল। তোমাকে ঠিক এক মিনিট সময় দেয়া হল তার জন্য। আজিজ মাস্টার কাপড় খুলতে শুরু করল।
রফিক, আমার কথা বিশ্বাস হল?
হল।
বাঙালিদের মান-অপমান বলে কিছু নেই। একটা কুকুরেরও আত্মসম্মান জ্ঞান থাকে, এদের তাও নেই। আমি যদি ওকে বলি—যাও, ঐ ইমামের পশ্চাৎদেশ চেটে আস, ও তাই করবে।
রফিক মৃদু স্বরে বলল, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালে অনেকেই এ-রকম করবে।
তুমি রবে?
জানি না, করতেও পারি। মৃত্যু একটা ভয়াবহ ব্যাপার। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে কে কী করবে তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়।
তাই বুঝি?
জ্বি স্যার। আপনার মতো একজন সাহসী মানুষও দেখা যাবে কাপুরুষের মতো কাণ্ডকারখানা করছে।
মেজর সাহেব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। এবং তারো মিনিটখানেক পর জয়নাল মিয়াকে সেই ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। আজিজ মাষ্টার দুহাতে তার লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করল। ইমাম সাহেব বেশ স্বাভাবিক গলায় বললেন, জয়নাল মিয়া ভালো আছেন?
জয়নাল কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল—বলতে পারল না। আজিজ মাস্টারের মতো একজন বয়স্ক মানুষ সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে—এটি এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইমাম সাহেব বললেন, বড় খারাপ সময় জয়নাল সাব, আল্লাহ্ খোদার নাম নেন।
জয়নাল মিয়া আবারো কিছু বলতে চেষ্টা করল, বলতে পারল না। কথা আটকে গেল।
রফিক শান্ত স্বরের বলল, জয়নাল সাহেব, আপনি বসেন। স্যার যা যা জিজ্ঞেস করবেন তার সত্যি জবাব দেবেন। বুঝতেই পারছেন।জয়নাল মিয়া মাটিতে বসে পড়ল। ইমাম সাহেব বললেন, চেয়ারে বসেন, মাটিতে প্রস্রাব আছে। নাপাক জায়গা।
১৪.
মেঘ নেই।
আকাশে তারা ফুটতে শুরু করেছে।
রাত প্রায় আটটা, কিন্তু মনে হচ্ছে নিশুতি। হাওয়া থেমে গেছে। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। সফরউল্লাহ্ একটা দা হাতে মাঠে নেমে পড়ল। সে দু জনকে খুজছে। এক জন তালগাছের মতো লম্বা। গোঁফ আছে। অন্য জন বাঙালি, তার মুখে বসন্তের দাগ। সফরউল্লাহ কোনো রকম শব্দ না করে হাঁটছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাতে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। সে যেভাবে হাঁটছে তাতে মনে হয় অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছে। কোনো-কোনো সময়ে মানুষের ইন্দ্রিয় অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
সে প্রথমে গেল বিলের দিকে। কেউ নেই সেখানে। বেশ কিছু কাটা ডাব পড়ে আছে চারদিকে। সফদরউল্লাহ্ দীর্ঘ সময় বিলের পারে দা হাতে বসে রইল। বাতাস নেই কোথাও, তবু বিলের পানিতে ছলাৎছলাৎ শব্দ হচ্ছে। ওরা আবার হয়তো আসবে। পানিতে দাঁড় করিয়ে আরো মানুষ মারবে। সফরউল্লাহর মনে হল কেউ-একজন যেন এদিকে আসছে। সে শক্ত করে দাটি ধরে চেঁচিয়ে বলল, কেডা?
আমি নিজাম। আপনে কী করেন?
কিছু করি না।
অন্ধকারে বইয়া আছেল কাল?
সফদরউল্লাহ ফুঁপিয়ে উঠল। নিজাম বলল, সব মিলিটারি জমা হইতেছে জঙ্গলা মাঠে। দেখবেন? সফরউল্লাহ্ সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।
হাতে দাও ক্যান?
আছে, কাম আছে। দাওয়ের কাম আছে।
কৈবর্তপাড়া খালি হয়ে যাচ্ছে।
এরা সরে পড়ছে নিঃশব্দে। এদের অভ্যাস আছে—অতি দ্রুত সব কিছু গুছিয়ে সরে পড়তে পারে। অন্ধকারে এরা কাজ করে। ওদের শিশুরা চোখ বড়-বড় করে দেখে, হৈচৈ করে না, কিছুই করে না। মেয়েরা জিনিসপত্র নৌকায় তুলতে থাকে। কোনো জিনিসই বাদ পড়ে না। হাঁস, মুরগি, ছাগল—সবই ওঠানো হয়। এরা কাজ করে নিঃশব্দে। প্রবীণরা ইকো হাতে বেশ অনেকটা দূরে বসে থাকে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় কি হচ্ছে না হচ্ছে এরা কিছুই জানে না। এরা ঝিমুতে থাকে। ঝিমুতে ঝিমুতেই চারদিকে লক্ষ রাখে। বুড়ো বয়সেও এদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।