যে অল্প ক জন এসেছিল তারা ঝড়ের মধ্যেই চলে গেল। ঝড় থামবার পর জয়নাল মিয়ার কাছে খবর এল—মেজর সাহেব তার সঙ্গে দেখা করতে চান। সে যেন দেরি না করে। জয়নাল মিয়া ভীত স্বরে বলল, যাও, গিয়া বল, আমি আসছি। বাঙালি রাজাকারটি বিরক্ত মুখে বলল, আমার সাথে চলেন। সাথে যাইতে বলছে।
সফরউল্লাহর বাড়ির সামনে এসে জয়নাল মিয়ার মনে হয় ভেতরের বাড়িতে মেয়েছেলে কাঁদছে। সফরউল্লাহ্উঠোনে বসে আছে। জয়নাল মিয়া জিজ্ঞেস করল, কী হইছে? সফরউল্লাহ জবাব দিল না।
কান্দে কে?
সফরউল্লাহ্ সেই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। সঙ্গের রাজাকারটি জয়নাল মিয়ার পিঠে ঠেলা দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি হাঁটেন।
মেজর সাহেব এক মগ কফি হাতে
১৩.
মেজর সাহেব এক মগ কফি হাতে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর সমস্ত গা ভেজা। মাথায় টুপি নেই। ভেজা চুল বেয়ে ফোঁটা-ফোঁটা পানি পড়ছে। আজিজ মাস্টার উঠে দাঁড়াল। ইমাম সাহেব বসেই রইলেন। তাঁর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। কিছু সময় পরপরই তাঁর বমি হচ্ছে। ঘরময় বমির কটু গন্ধ। রফিক একটি হারিকেন টেবিলের উপর রেখে চেয়ার এগিয়ে দিল মেজর সাহেবের দিকে। তিনি বসলেন। একটি পা রাখলেন চেয়ারে। গভীর গলায় প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। প্রশ্নগুলি ইমাম সাহেবের প্রতি। রফিককে প্রতিটি প্রশ্ন ও উত্তর ইংরেজি করে দিতে হচ্ছিল। প্রশ্নোত্তর পর্বের গতি হল শুথ, সে ওন্যে মেজর সাহেবের কোনো ধৈর্ষচ্যুতি হল না।
তারপর, ইমাম ভালো আছ?
জ্বি।
আমি তো খবর পেলাম ভালো নেই। ক্রমাগত বমি হচ্ছে।
জ্বি হুজুর।
শাস্তির দৃশ্যটা ভালো লাগে নি?
ইমাম সাহেব জবাব দিলেন না। বমির বেগ সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ম ওর সাহেবের মুখে ক্ষীণ হাসি দেখা গেল।
দৃশ্যটি কি খুব কঠিন ছিল?
জ্বি।
তুমি নিজে নিশ্চয়ই গরু-ছাগল জবাই করা কর না?
জ্বি, করি।
তখন খারাপ লাগে না?
ইমাম সাহেব একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। মেজর সাহেব কফির মগে দীর্ঘ। চুমুক দিয়ে জবাবের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। জবাব পাওয়া গেল না।
ইমাম।
জ্বি স্যার।
এখন আমাকে বল, তোমাদের ঐ জঙ্গলে মোট কত জন বাঙালি সৈন্য আছে?
আমি জানি না স্যার।
সঠিক সংখ্যাটি না বলতে পারলেও কোনো ক্ষতি নেই। অনুমান করে বল।
আমি জানি না স্যার।
সৈন্য আছে কিনা সেটা বল।
স্যার, আমি জানি না।
আচ্ছা বেশ—সৈন্য নেই, এই কথাটিই তোমার মুখ থেকে শুনি।
স্যার, আমি জানি না। কিছুই জানি না স্যার।
মেজর সাহেব কফির মগ নামিয়ে রাখলেন। সিগারেট ধরালেন। তার কপালের চামড়ায় সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল।
তুমি কখনো ঐ বনে যাও নি?
জ্বি-না স্যার। আমি ধর্মকর্ম নিয়ে থাকি।
ধর্মকর্ম নিয়ে থাক?
জ্বি স্যার।
মসজিদে লোক হয়?
হয় স্যার।
সেখানে তুমি কি পাকিস্তানের জন্যে দোয়া কর?
ইমাম সাহেব চুপ করে গেলেন। মেজর সাহেবের কণ্ঠে অসহিষ্ণুতা ধরা পড়ল।
খুতবার শেষে পাকিস্তানের জন্যে কখনো দোয়া কর নি?
পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্যে দোয়া খায়ের করা হয় স্যার।
তুমি আমার কথার জবাব দাও। পাকিস্তানের জন্যে দোয়া কর নি?
জ্বি-না স্যার। বাংলাদেশের জন্যে কখনো দোয়া করেছ?
ইমাম সাহেব চুপ করে রইলেন।
মেজর সাহেব হঠাৎ প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিলেন। ইমাম সাহেব চেয়ার থেকে উল্টে পড়ে গেলেন। রফিক তাঁকে উঠে বসাল। মেজর সাহেব ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, ব্যথা লেগেছে?
জ্বি-না।
এতটুকু ব্যথা লাগে নি।
জ্বি-না স্যার।
আমার হাত এতটা কমজোরি তা জানা ছিল না।
মেজর সাহেব হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে দ্বিতীয় চড়টি দিলেন। ইমাম সাহেব গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলেন। তার নাক দিকে রক্ত পড়তে শুরু করল। রফিক তাঁকে তুলতে গেল। মেজর সাহেব বললেন, ও নিজে নিজেই উঠবে। ইমাম, উঠে বস। ইমাম সাহেব উঠে বসলেন।
এখন বল, তুমি শেখ মুজিবর রহমানের নাম শুনেছ?
জি, শুনেছি।
সে কে?
ইমাম সাহেব চুপ করে রইলেন।
সে কে তুমি জান না?
মেজর সাহেব এগিয়ে এসে তৃতীয় চড়টি বসালেন। ইমাম সাহেব শব্দ করে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন। মেজর সাহেব তাকালেন আজিজ মাস্টারের দিকে।
তারপর কবি, তুমি কেমন আছ? ভালো আছ?
জি।
তুমি শুনলাম বেশ শক্তই ছিলে? বমিটমি কিছু কর নি?
আজিজ মাস্টার জবাব দিল না।
বাংলাদেশের উপর কখনো কবিতা লিখেছ?
জ্বি-না স্যার।
কেন, লেখ নি কেন?
আজিজ মাস্টার চুপ করে রইল।
শেখ মুজিবের ওপর লিখেছ?
জ্বি-না।
আজিজ মাস্টারের পা কাঁপতে লাগল। মেজর সাহেব বললেন, তুমি প্রেমের কবিতা ছাড়া অন্য কিছু লেখ না?
জ্বি-না।
তুমি দেখি দারুণ প্রেমিক-মানুষ। সব কবিতা কি মাল নামের ঐ বালিকাটিকে নিয়ে লেখা? জবাব দাও। বল হ্যাঁ কিংবা না।
হ্যাঁ।
শোন আজিজ, আমি কথা রাখি। আমি কথা দিয়েছিলাম ঐ মেয়েটির সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করব, সেটা আমার মনে আছে। আমি ঐ মেয়ের বাবাকে আনকে লোক পাঠিয়েছি। এখন তুমি আমাকে বল, ঐ বনে কত জন সৈন্য লুকিয়ে আছে?
স্যার, বিশ্বাস করেন আমি কিছুই জানি না।
আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম না। তুমি বোধহয় জান না আমি কী পরিমাণ নিষ্ঠুর হতে পারি। তুমি জান?
জ্বি স্যার, জানি।
না, তুমি জান না। তবে এক্ষুণি দেখতে পাবে। রফিক, তুমি ওর জামা-কাপড় খুলে ওকে নেংটো করে ফেল।
আজিজ মাস্টার হতভম্ব হয়ে তাকাল। এই লোকটা বলে কী। আজিজ মাস্টারের পা কাপতে লাগল। মেজর সাহেব বললেন, দেরি করবে না, আমার হাতে সময় বেশি নেই। রফিক।