বদিউজ্জামান খুকখুক করে দু বার কাশল। নিজের কাশির শব্দে নিজেই চমকে উঠল। কেমন বেকুবের মতো কাণ্ড করছে। নির্জন জায়গা। অল্প শব্দ হলেই অনেক দূর থেকে শোনা যায়। আবার কাশি আসছে। বদিউজ্জামান কাশি সামলাবার চেষ্টা করতে গিয়ে ঘড়ঘড় একটা শব্দ বের করল। গিরগিটিটা ভয় পেয়ে চলে যাচ্ছে। না, হচ্ছে না, আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে। পানি খেতে এসেছে বোধহয়। তাকে দেখে পানি খাবার হল হচ্ছে না, আবার তৃষা নিয়ে চলেও যেতে পারছে না।
বদির আবার তৃষ্ণা বোধ হল। সে মাথা নিচু করে কয়েক ঢোক পানি খেল।
১০.
নীল শার্ট পরা লোকটি বলল, আপনারা দু জন আসেন আমার সঙ্গে। আজিজ মাষ্টার তাকাল ইমাম সাহেবের দিকে। ইমাম সাহেব ভীত স্বরে বললেন, কোথায়? নীল শার্ট পর লোকটির মূখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। তাকে কোনো প্রশ্ন দ্বিতীয় বার করার সাহস হয় না। তবু ইমাম সাহেব দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?
বিলের কাছে।
কেন?
মেজর সাহেব নিয়ে যেতে বলেছেন।
কী জন্যে?
এত কিছু জিজ্ঞেস করবার দরকার নেই। আপনারা উঠেন। মেজর সাহেব অপেক্ষা করছেন।
বড় ভয় লাগতেছে ভাই।
ভয়ের কিছু নাই—আসেন।
আজিজ মাস্টার একটি কথাও বলল না। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। সবার শেষে বেরুলেন ইমাম সাহেব। তিনি খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছিলেন।
স্কুলঘরের বারান্দায় কেউ নেই। ধু-ধু করছে চারদিক। বসে থাকা সেপাইরা কখন গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে, কে জানে। ঘরের ভেতরে বসে কিছুই বোঝা যায় নি। হয়তো কোনো পাহারাটাহারা ছিল না। ইচ্ছা করলেই পালিয়ে যাওয়া যেত। ইমাম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এরা সব কোথায় গেল?
নীল শার্ট পরা লোকটি বলল, বেশি কথা বলবেন না। আপনারা মৌলবী-মুসুল্লিরা বেশি কথা বলেন আর ঝামেলার সৃষ্টি করেন। কম কথা বলবেন।
জি আচ্ছা।
ইউনিয়ন বোর্ডের সড়ক পর্যন্ত তারা এগোল নিঃশব্দে। জুমাঘরের পাশে আট-ন জন সেপাইয়ের একটি দল দাঁড়িয়ে আছে। তারা তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ইমাম সাহেবের ঘন-ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। তিনি নীল শার্ট পরা লোকটির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, ভাই, আপনার নাম কি?
রফিক। রফিক সাহেব, আমার জোহরের নামাজ কাজা হয়ে গেছে। পানির অভাবে অজু করতে পারি নাই।
রফিক তার কোনো জবাব দিল না। আগে-আগে হাঁটতে লাগল। কোথাও কোনো মানুষজন নেই। গ্রামের সবাই কি ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে নাকি? ইমাম সাহেব বললেন, ভাই, আপনার দেশ কোথায়? বাড়ি কোন জিলায়?
বাড়ি দিয়ে কী করবেন?
না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। আমার দেশ কুমিল্লা। নবীনগর।
ভালো।
সামনের মাসে ইনশাল্লাহ দেশে যাব। বহুত দিন যাই না।
রফিক কিছুই বলল না। সে হাঁটছে মাথা নিচু করে। এমনভাবে হাঁটছে যেন। পথঘাট খুব ভালো চেনা। কিন্তু এ-লোকটি এই গ্রামে আগে কখনো আসে নি। আজিজ মাস্টার বলল, মেজর সাহেব কেন ডেকেছেন আপনি জানেন?
জানি।
জানলে আমাদের বলেন।
রফিক নিস্পৃহ স্বরে বলল, একটি অপরাধীর বিচার হবে। ওর নাম, মনা। সে খুন করেছে। সেই খুন নিয়ে কোনো থানা-পুলিশ হয় নি। এক বুড়ি নালিশ করেছে মেজর সাহেবের কাছে। ঐ বুড়ির নাম চিত্ৰা বুড়ি।
ইমাম সাহেব বললেন, চিত্রা বুড়ি। খুব বজ্জাত। মসজিদের একটা বদনা চুরি করেছে।
বদনা চুরি করুক আর না-করুক মেজর সাহেব তার কথা শুনে খুব রাগ করেছেন। মনাকে ধরা হয়েছে। কঠিন শাস্তি হবে।
আজিজ মাস্টার ক্ষীণ স্বরে বলল, কী শাস্তি?
মিলিটারিদের তো আর জেল-হাজত নাই যে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। ওদের শাস্তি একটাই। ছোট অপরাধের জন্যে যে-শাস্তি, বড়ো অপরাধের জন্যেও সেই শাস্তি।
কী সেটা?
বুঝতেই তো পারছেন, আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?
ইমাম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, আমরা গিয়ে কী করব?
আপনারা শাস্তি দেখবেন।
শাস্তি দেখব।
হ্যাঁ।
এর দরকার আছে।
কী দরকার?
মেজর সাহেবের ধারণা, এটা দেখার পর আপনারা তাঁর কথা শুনবেন। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে সোজাসুজি জবাব দেবেন।
ও।
শুনেন ইমাম সাহেব, আপনি কথা বেশি বলেন। কথা বেশি বলে এক বার মার খেয়েছেন। কথা খুব কম বলবেন।
জ্বি আচ্ছা।
নিজের থেকে কোনো কথা বলবেন না। এখন সময় খারাপ।
জ্বি, তা ঠিক।
ইমাম সাহেব চুপ করে গেলেন।
মীর আলি বাড়ির উঠোনে বসে ছিল। আজ বাড়িতে রান্না হয় নি। খিদের যন্ত্রণায় সে অস্থির হয়ে পড়ল। এই বয়সে খিদে সহ্য হয় না। অনুফাকে কয়েক বার ভাতের কথা বলাও হয়েছে। কিন্তু অনুফা কিছু করছে না। সে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। ভাত রাঁধায় তার মন নেই। ভয় মীর আলিরও লাগছে। কিন্তু খিদের কষ্ট বড় কষ্ট।
আজিজ মাস্টাররা তার বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় সে এক থালা মুড়ি নিয়ে বসে ছিল। এই বয়সে মুড়ি চিবোতে কষ্ট হয়, তবু চিবোতে হয়। যা ভাবসাব তাতে মনে হচ্ছে আজ আর রান্না হবে না। পায়ের শব্দে মীর আলি চমকে উঠে বলল, কেড়া যায়?
আমি আজিজ। আজিজ মাস্টার।
তোমার সঙ্গে কেডা যায়?
আজিজ মাস্টার জবাব দিল না।
কথা কও না যে! ও মাষ্টার, মাস্টার।
রফিক বলল, দাঁড়াবেন না, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ও মাস্টার, কে কথা কয়?
রফিক শীতল স্বরে বলল, আমার নাম রফিক। চাচা মিয়া, আপনি ঘরের ভেতরে গিয়ে বসেন।
মাস্টার, এই লোকটা কে? মিলিটারি?
না। আমি মিলিটারি না।
আপনার বাড়ি কোন গ্রাম?