- বইয়ের নামঃ ১৯৭১
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের-বই
মীর আলি চোখে দেখে না
০১.
মীর আলি চোখে দেখে না।
আগে আবছা আবছা দেখত। দুপুরের রোদের দিকে তাকালে হলুদ কিছু ভাসত চোখে। গত দু বছর ধরে তাও ভাসছে না। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। তাঁর বয়স প্রায় সত্তুর। এই বয়সে চোখ-কান নষ্ট হতে শুরু করে। পৃথিবী শব্দ ও বর্ণহীন হতে থাকে। কিন্তু তার কান এখনো ভালো। বেশ ভালো। ছোট নাতনীটি যত বার কেঁদে ওঠে তত বারই সে বিরক্ত মুখে বলে, চুপ, শব্দ করিস না। মীর আলি আজকাল শব্দ সহ্য করতে পারে না। মাথার মাঝখানে কোথায় যেন ঝনঝন করে। চোখে দেখতে পেলেও বোধহয় এরকম হত— আলো সহ্য হত না। বুড়ো হওয়ার অনেক যত্র শা। সবচেয়ে বড়ো যন্ত্রণা রাত-দুপুরে বাইরে যেতে হয়। একা-একা যাওয়ার উপায় নেই। তাকে তলপেটের প্রবল চাপ নিয়ে মিহি সুরে ডাকতে হয়, বদি, ও বদি। বদিউজ্জামান।
বদিউজ্জামান তার বড় ছেলে। মধুবন বাজারে তার একটা মনিহারী দোকান আছে। রোজ সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে সাত মাইল হেঁটে সে বাড়ি আসে। পরিশ্রমের ফলে তার ঘুম হয় গাঢ়। সে সাড়া দেয় না। মীর আলি ডেকেই চলে—বদি, ও বদি। বদিউজ্জামান। জবাব দেয় তার ছেলের বৌ অনুফা। অনুফার গলার স্বর অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সেই তীক্ষ্ণ স্বর কানে এলেই মীর আলির মাথা ধরে, তবু সে মিষ্টি সুরে বলে, ও বৌ, এটু বাইরে যাওন দরকার। বদিরে উঠাও।
অনুফা তার স্বামীকে জাগায় না। নিজেই কুপি হাতে এগিয়ে এসে শ্বশুরের হাত ধরে। বড় লজ্জা লাগে মীর আলির। কিন্তু উপায় কী? বুড়ো হওয়ার অনেক যন্ত্রণা। অনেক কষ্ট। মীর আলি নরম স্বরে বলে, চাঁদনি রাইত নাকি, ও বৌ।
জ্বি-না।
চউখে ফসর-ফসর লাগে। মনে হয় চাঁদনি।
না, চাঁদনি না। এইখানে বসেন। এই নেন বদনা।
অনুফা দূরে সরে যায়। মীর আলি ভারমুক্ত হয়। অন্য রকম একটা আনন্দ হয় তার। ইচ্ছা করে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকতে। অনুফা ডাকে, আব্বাজান, হইছে?
হুঁ।
উঠেন। বইসা আছেন কেন?
ফজর ওয়াক্তের দেরি কত?
দেরি আছে। আব্বাজান উঠেন।
মীর আলি অনুফার সাহায্য ছাড়াই উঠোনে ফিরে আসে। দক্ষিণ দিক থেকে সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। রাতের দ্বিতীয় প্রহর শেষ হয়েছে বোধহয়। একটা-দুটা করে শিয়াল ডাকতে শুরু করেছে। মীল আলি হৃষ্ট গলায় বলে, রাইত বেশি বাকি নাই।
অনুফা জবাব দেয় না, হাই তোলে।
একটা জলচৌকি দেও, উঠানে বইয়া থাকি।
দুপুর-রাইতে উঠানে বইবেন কি? যান, ঘুমাইতে যান।
মীর আলি বাধ্য ছেলের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ে। এক বার ঘুম ভাঙলে বাকি রাতটা তার জেগে কাটাতে হয়। সে বিছানায় বসে ঘরের স্পষ্ট অস্পষ্ট সব শব্দ অত্যন্ত মন দিয়ে শোনে।
বদি খুকখুক করে কাশছে। টিনের চালে ঝটপট শব্দ। কিসের শব্দ? বানর? চৌকির নিচে সবগুলি হাঁস একসঙ্গে প্যাকপ্যাক করল। বাড়ির পাশে শেয়াল হাঁটাহাটি করছে বোঝহয়। পরীবানু কেঁদে উঠল। দুধ খেতে চায়। অনুফা দুধ দেবে না। চাপা গলায় মেয়েকে শাসাচ্ছে। বদি আবার কাশছে। ঠান্ডা লেগেছে নাকি? পরশু দিন ভিজে বাড়ি ফিরেছে। জুর তো হবেই। বদির কথা শোনা যাচ্ছে। ফিসফিস করে কী-যেন বলছে। কী বলছে? এত ফিসফিসানি কেন? মীর আলি কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে। কাক ডাকল। সকাল হচ্ছে নাকি? মীর আলি ভোরের প্রতীক্ষা করে–তার তলপেট আবার ভারি হয়ে ওঠে।
বদি, ও বদি। বদিউজ্জামান।
কি?
এটু বাইরে যাওন দরকার।
বদি সাড়াশব্দ করে না। পরীবানু তারস্বরে কাঁদে। দুধ খেতে চায়।
ও বদি, বদিউজ্জামান।
আসি, আসি।
তাড়াতাড়ি কর।
আরে দুত্তোরি। এক রাইতে কয় বার বাইরে যাইবেন?
বদি প্রচন্ড একটা চড় বসায় পরীবানুর গালে। বিরক্ত গলায় বলে, টর্চটা দাও অনুফা।
অনুফা টর্চ খুঁজে পায়, কিন্তু অন্ধকারে ব্যাটারি খুঁজে পায় না।
মীর আলি অপেক্ষা করতে-করতে এক সময় অবাক হয়ে বুঝতে পারে তার প্রস্রাব হয়ে গেছে। বিছানার একটা অংশ ভেজা। সে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করে। এ রকম তার আগে কখনো হয় নি।
আসেন যাই। যত ঝামেলা। দেখি, হাতটা বাড়ান।
বদি তার হাত ধরে। মীর আলি খুব দুর্বল ও অসহায় বোধ করে। এখন থাইক্যা ঘরের মইধ্যে একটা পাতিলে পেশাব করবেন। ঝামেলা ভালো লাগে না।
আইচ্ছা।
আর পানি কম খাইবেন। বুঝলেন?
আইচ্ছা।
বদি তাকে উঠোনের এক মাথায় বসিয়ে দেয়। মীর আলি প্রস্রাব করার চেষ্টা করে। প্রস্রাব হয় না—ভোঁতা একটা যন্ত্রণা হয়।
বদি হাঁক দেয়, কী হইছে? রাইত শেষ করবেন নাকি?
আর ঠিক তখন মীর আলির সামনে দিয়ে সরসর শব্দ করে একটা কিছু চলে যায়। এটা কী সাপ? মীর আলির দেখতে ইচ্ছা করে।
আরে বিষয় কি, সুমাইয়া পড়ছেন নাকি?
নাহ্! একটা সাপ গেল সামনে দিয়া।
আরে দুত্তোরি সাপ–উঠেন দেখি।
মনে হয় জাতি সাপ। বিরাট লম্বা মনে হইল।
আরে ধুৎ, উইঠা আসেন।
মীর আলি উঠে দাঁড়ায়। আর ঠিক তখন আজান হয়। মীর আলি হাসিমুখে লে, আজান দিছে। ও বদি, আজান দিছে।
দিছে দেউখ। ঘরে চলেন।
ওখন আর ঘরে গিয়া কী কাম? গোসলের পানি দে। গোসল সাইরা নামাজটা
বদি বিরক্ত গলায় বলে, অজু কইরা নামাজ পড়েন। গোসল ক্যান?
শইলড়া পাক না। নাপাক আইল।
আপনে থাকেন বইয়া, অনুফারে পাঠাই। যত ঝামেলা।