দোয়া ইউনুস কিছুতেই মনে করতে পারলাম না! কাদের মতিন সাহেবের শার্ট টেনে চাপা স্বরে বলল সিগারেট ফেলেন। আগুন দূর থাইক্যা দেখা যায়।
গাড়িটি এইখানে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? না, চলতে শুরু করেছে। এই তো যাচ্ছে বড়ো রাস্তার দিকে। আমার দেয়া ইউনুস মনে পড়ল। লাইলাহা ইল্লা আন্তা সোবাহানিক ইনি কুন্তু মিনায যোয়ালোমিন।
জলপরী
জলিল সাহেবের ভাই এখনো দেশে ফেরেন নি।
সমগ্র ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছেন। কীভাবে-কীভাবে যেন এক জন কর্নেলের সঙ্গে দেখা করে দরখাস্ত দিয়ে এসছেন। দৈনিক পাকিস্তানে সন্ধান চাই–এই শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন এবং সন্ধানদাতাকে নগদ পাঁচ শ টাকা পুরস্কারের কথাও ঘোষণা করেছেন।
পুরস্কার ঘোষণা কাজে দিয়েছে বলা যেতে পারে। কালো মতো লম্বা এক লোক এসে হাজির। তার চোখে নিকেলের চশমা, নিচের পাটির একটি দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধান। জলিল সাহেবের ভাই লোকটিকে আমার কাছে এনে হাজির করলেন। লোকটির বক্তব্য, বিজ্ঞাপনের বর্ণনা মতো এক জন লোক মীরপুর বারো নম্বরে আটক আছে। তাকে ছাড়িয়ে আনা যাবে না, তবে এক হাজার টাকা দিলে সে দেখা করিয়ে দিতে পারে। আমে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। যথাসম্ভব শান্ত স্বরে বললাম, আপনি নিজে দেখেছেন?
জ্বি জনাব। নিজে না দেখলে বলি কেন? তবে আগের মতো নাই, অনেক রোগা হয়ে গেছেন।
আপনি দেখলেন কীভাবে? মীরপুর বারো নম্বরে আপনি কী করেন?
আমার চেনাজানা লোক আছে।
বাড়ি কোথায় আপনার?
বাড়ি দিয়ে আপনার দরকার কী? দেখা করিয়ে দিলেই তো হয়।
কখন দেখা করবেন?
এখন বলতে পারব না। খোঁজখবর নিয়ে বলতে হবে।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, আপনার সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন এক কাজ করেন না কেন, জলিল সাহেবকে দিয়ে এক লাইনের একটা লেখা লিখিয়ে আনেন, আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে এক হাজার টাকা দেয়া হবে।
লোকটি সঙ্গে সঙ্গে রেগে উঠল।
আপনে আমার কথা বিশ্বাস ক-রেন নাই। আপনার সাথে ভাই আমি নাই। আমার এক কথা, আমি দেখা করিয়ে দিব। কিন্তু টাকাটা আমাকে এখন দিতে হবে।
এখন দিতে হবে?
জ্বি জনাব। অর্ধেক এখন দেন, আর বার্কি অর্ধেক দেখা হওয়ার দিন দেন। ব্যস, সাফ কথা।
আমি ঠাণ্ডা গলায় কাদেরকে বললাম, এই লোকটাকে ঘাড় ধরে বের করে দে কাদের।
জলিল সাহেবের ভাই দারুণ অবাক হয়ে বললেন, আরে না-না। এই সব কী বলছেন? আসেন তো ভাই আপনি আমার সাথে চা-পানি খান। আসেন দেখি। অবিশ্বাস করার কী আছে? মাকুদে এলাহী, অবিশ্বাস করব কেন? আপনি কি আর খামাখা মিথ্যা কথা বলবেন?
সন্ধ্যাবেলা খবর পেলাম লোকটিকে পাঁচ শ টাকা দেওয়া হয়েছে এবং একটি টিফিন কেরিয়ারে করে গোশত পারোটা দেওয়া হয়েছে পৌঁছে দেবার জন্যে। লোকটি বলে গেছে সে বৃহস্পতিবার বিকালে এসে জলিল সাহেবের ভাইকে মীরপুর বার নম্বরে নিয়ে যাবে। লোকটি যে আর আসবে না, সেই সম্পর্কে আমি ষোল আনা নিশ্চিত ছিলাম।
কিন্তু সে সত্যি সত্যি বৃহস্পতিবার বেলা দুটার সময় এসে হাজির। খালি টিফিন–কেরিয়ারটিও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। সে অবশ্যি দেখা করানর জন্যে জলিল সাহেবের ভাইকে মীরপুরে নিয়ে গেল না। তার জন্যে নাকি অন্য এক বিহারী ব্যক্তির (সুলায়মান খা) সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া প্রয়োজন। সেই লোক রোববার আসবে। রোববারে অবশ্যি দেখা হবে। এই বারও লোকটি একটি কম্বল, একটি বালিশ এবং দু, শ টাকা নিয়ে গেল!
জলিল সাহেবের ভাইয়ের ধৈর্য সীমাহীন। তিনি রোববার ভোরে গেলেন, মঙ্গলবার দুপুরে গেলেন এবং আবার বৃহস্পতিবার সকালে গিয়ে সন্ধ্যাবেলা গায়ে জ্বর নিয়ে ফিরে এলেন। আমি দেখতে গেলাম রাতে। বেশ জ্বর। ভদ্রলোক লেপ গায়ে দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে উঠে বসতে চেষ্টা করলেন, শুয়ে থাকেন, উঠতে হবে না। আজকেও দেখা হয় নি?
জ্বি-না। সামনের মাসের দুই তারিখ যাইতে বলে যাবেন?
জ্বি-না। ওরা কোনো খোঁজ জানে না। শুধু পেরেশানী করে।
এতদিনে বুঝলেন?
বুঝেছি আগেই ভাই, কিন্তু কী করব।–মিথ্যাটাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়।
আরো খোঁজখবর করবেন?
জ্বি-না, আগামী মঙ্গলবার ইনশাল্লাহ দেশের বাড়ি রওনা হব।
ঠিক আছে, আপনি বিশ্রাম করেন। পরে কথা বলব।
না ভাই, একটু বসেন। এক কাপ চা খান। আমিনা, ও আমিনা।
আমিনা সম্ভবত জলিল সাহেবের স্ত্রী। কঠিন পর্দা এদের। তিনি এলেন না। দরজার ওপাশে খটখট শব্দে জানান দিলেন। জলিল সাহেবের ভাই শান্ত স্বরে বললেন, আমিনা, রোজ কেয়ামতের দিন কোনো পর্দা থাকে না। মেয়ে-পুরুষ তখন সব সমান। এখন সময়টা কেয়ামতের মতো। এখন কোনো পর্দা-পুশিদা নাই। তুমি আস চা নিয়া।
জলিল সাহেবের স্ত্রীকে দেখে আমি বড়োই অবাক হলাম। নিতান্ত বাচ্চা একটি মেয়ে। শ্যামলা ছিপছিপে গড়ন। খুব লম্বা ঘন কালো চুল। এই বয়সের মেয়েরা বেণী দুলিয়ে স্কুলে যায়। হাত ভর্তি আচার নিয়ে বারান্দায় বসে চেটে চেটে খায়। মেয়েটি নিজে থেকেই বলল, আপনার কি মনে হয়, তাঁকে মেরে ফেলেছে?
আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারলাম না। মেয়েটি থেমে থেমে বলল, তাঁকে কেন মারবে বলেন? সে তো কিছুই করে নাই। সে তো মানুষকে একটা কড়া কথা পর্যন্ত বলতে পারে না! সাত বৎসর বয়স থেকে কোনো নামাজ কাজ করে নাই। কেন আল্লাহ্ এমন করবেন?
জলিল সাহেবের ভাই গম্ভীর হয়ে বললেন, আল্লাহর কাজের কোনো সমালোচনা নাই আমিনা। গাফুরুর রাহিম যা জানেন, আমরা সেইটা জানি না।