অন্য বারের মতো টাকাটা দিয়েই নিচে নেমে যায় নি, হঠাৎ করে বলেছে, আপনার বন্ধু কনিকের কোনো খোঁজ পেলেন?
না, এখনো পাই নি।
আমার মনে হয়, সে মনের দুঃখে বিবাগী হয়েছে।
নীলু খিলখিল করে হেসে উঠেই গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি খুব সুখে আছেন শফিক সাহেব। কাজটাজ কিছু করতে হয় না। বাড়িভাড়া নেন, আর ঘুরে বেড়ান।
আমি উত্তর দিলাম না। সে দেখলাম খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, বাবা আপনাকে খুব পছন্দ করেন।
তাই নাকি?
তাঁর ধারণা, আপনার মতো ভালো ছেলে খুব কম জন্মায়।
আমি হঠাৎ বলে বসলাম, উনি আমার পা দেখতে পান না তো, তাই বলেন।
এরপর কথা আর এগোয় নি। নীলু মুখ কালো করে নিচে নেমে গেছে। আমি নিজেও ভেবে পাই নি, হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কেন তুললাম। না ভেবেচিন্তে মানুষ অনেক কিছুই বলে। আর বলে বলেই আমরা ভালো মানুষ আর মন্দ মানুষকে আলাদা করতে পারি। এই যেমন আজ মতিনউদ্দিন সাহেব ভাত মাখতে মাখতে বললেন, মিলিটারিগুলি দেখতে বেশ লাগে। কেমন স্মাট।
ভদ্রলোকের এই কথা থেকেই বোঝা যায়, এর মনে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। এখনো মিলিটারি দেখে যে মুগ্ধ হয় সে কিছু পরিমাণে ছেলেমানুষ। স্বামী হিসেবে এ ধরনের মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে যাচ্ছি, তখন কাদের এসে উপস্থিত। সে আমাকে এক কোণায় নিয়ে চোখ ছোট করে বলল, ছোড ভাই, রোজ কেয়ামত।
কী হয়েছে?
রফিক সাহেবের ছোড ভাইয়ের খেল খতম।
কী বলিস।
কোনো খোঁজ নাই। তার মা ফিট হয়। আর উঠে, আবার ফিট হয়।
আমি ভালোমতো বিদায় না নিয়েই গেলাম রফিকের বাসায়। বাসায় দেখি অনেক লোকজনের ভিড়। একটি ছোটমতো নীল রঙের গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকে দেখি রফিকের ছোট ভাই বসার ঘরে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তাকে ঘিরে বহু লোকজন।
রফিক আমাকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এল, খবর পেলি কার কাছে?
হয়েছেটা কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
শুনিস নি কিছু?
না।
কাল বিকালে বাইরে গিয়েছিল। সারা রাত আর ফেরে নি। আমাদের অবস্থাটা তো বুঝতেই পারছিস। মা রাতে তিন বার ফিট হয়েছে।
গিয়েছিল কোথায়?
ওর এক বন্ধুর বাড়ি। দেরি হয়েছিল বলে ওরা আর আসতে দেয় নি। বুঝে দেখি আমাদের অবস্থা।
রফিকের বাড়ি থেকে বেরুবার সময় দেখি আরো লোকজন আসছে। ঢাকা শহরের সব লোকজন কি জেনে গেছে নাকি–রাফিকের ছোট ভাই কাল রাতে বাড়ি ফেরে নি?
ঘরে ফিরে দেখি মতিনউদ্দিন সাহ বা দোতলার বিপ্লান্দায় বসে সিগারেট টানছেন। জুতো-টুতো খুলে পা তুলে বসেছেন। আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, সিগারেট খাবার জন্যে আসলাম। মুরুধিদের সামনে তো আর খাওয়া যায় না। কী বলেন?
তা তো ঠিকই। চা খাবেন?
তা বেশ তো। চা খেলে তো ভালোই হয়। অসুবিধা তো কিছু দেখছি না।
লোকটির মাথায় কি ছিট আছে? আমি আড়াচোখে তাকালাম তাঁর দিকে। কেমন নিশ্চিন্তে পা তুলে বসে আছেন। কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই।
শফিক ভাই, আমি রুসে বসে এতক্ষণ আপনার কাকটার কথা ভাবছিলাম, যার নাম রেখেছিলেন কনিষ্ক।
কী ভাবছিলেন?
না, বলা ঠিক হবে না। আপনাকে।
আমি আচমকা বললাম, আমেরিকায় কী করতেন আপনি?
পড়াশোনা। পি-এইচ. ডি করেছি। এগ্রনমিতে।
আমি অবাক হয়েই তাকালাম। কে বলবে এই লোকটির একটি পি-এইচ. ডি ডিগ্ৰী আছে? কেমন নির্বোধ চোখ। দিলাঢালা ভাবভঙ্গি। মতিনউদ্দিন সাহেব বিকাল পর্যন্ত আমার বারান্দায় বসে রইলেন। সন্ধ্যার আগে আগে তাঁকে নিতে তাঁর বড়ো ভাই আসবেন গাড়ি নিয়ে। তিনি গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমার বিরক্তির সীমা রইল না। বিলু এক বার এসে বলল নিচে যেতে। তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, বারান্দায় বেশ বাতাস, তিনি বাতাস ছেড়ে নিচে যেতে চান না। বিলুকে এইটুকু বলতেই তাঁর কান-টান লাল হয়ে একাকার হল।
সন্ধ্যাবেলা কোনো গাড়ি এল না। শোনা গেল, ঝিকাতলা এলাকায় কী–একটা ঝামেলা হয়েছে। ঝিকাতলা থেকে ধানমণ্ডি পনের নম্বর পর্যন্ত প্রতিটি বাড়ি নাকি সার্চ করা হবে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে একটা জীপে মাইক লাগিয়ে বলা হল, এই অঞ্চলে পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত কাৰ্য্য ঘোষণা করা হয়েছে। তার কিছুক্ষণ পরই কারেন্ট চলে গেল। কাদের হারিকেন জ্বলিয়ে আবার নিভিয়ে ফেলল। মিলিটারি সার্চের সময় অন্ধকার থাকাই নাকি ভালো। এতে তারা মনে করে, বাড়িতে লোকজন নেই। মতিনউদ্দিন সাহেব একেবারেই চুপ হয়ে গেলেন। বিলু যখন এসে বলল–খাবার দেওয়া হয়েছে, তিনি বললেন–তাঁর একেবারেই খিদে নেই।
গভীর রাত পর্যন্ত আমি এবং মতিনউদ্দিন সাহেব অন্ধকার বারান্দায় চুপচাপ বসে রইলাম, রাত একটায় বাসার সামনে দিয়ে একটি খোলা জীপ গেল। সেই জীপটিই আবার রাত দেড়টার দিকে ফিরে গেল!
আমি বললাম, ঘুমুবেন নাকি মতিন সাহেব? কাদের জায়গা করেছে।
মতিন সাহেব শুকনো গলায় বললেন, না, ঘুম আসছে না।
আমি বললাম ভয় লাগছে না?
জ্বি-না। বড্ড মশা।
মতিন সাহেব সিগারেট ধরিয়ে হঠাৎ বললেন, এটা বাংলা কোন মাস?
তার কথার জবাব দেবার আগেই জলিল সাহেবের স্ত্রীর কামনা শোনা গেল।
কে কাঁদে?
জলিল সাহেবের স্ত্রী। ওর স্বামীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
কী সর্বনাশ, বলেন কী আপনি!
মতিন সাহেব এমনভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন, যেন এ রকম ভয়াবহ কথা এর আগে শোনেন নি। সেই খোলা জীপটো এসে থামল বাসার গেটের কাছে। কাদের ফিসফিস করে বলল দোয়া ইউনুস পড়েন ছোড়া ভাই। ভয়ের কিছু নাই।