না।
আমাদের কেমিস্ট্রির স্যার এসে বললেন—এই…
বিলুর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সে কোনো কথা শেষ করবে না। হঠাৎ কথা থামিয়ে বলবে, সর্বনাশ, চুলায় রম পানি দিয়ে এসেছি, মনেই ছিল না। আমি যাই।
তোমাদের সেই কেমিস্ট্রি স্যার দুধ দেখে কী বললেন?
সে চোখ কপালে তুলে বলবে, দূর, এই সব শুনে কী করবেন?
বেশ লাগে আমার বিলুকে।
একটি গরম স্যুয়েটার গায়ে দিয়ে নামছি, হঠাৎ বিলু নিচু গলায় বলল, আমাদের বাসায় দেখবেন একটি লোক বসে আছে। ওর সঙ্গে নীলু আপার বিয়ে হবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তাই নাকি?
হুঁ।
কবে হচ্ছে বিয়েটা?
খুব শিগগির।
বিলু দেখলাম বেশ গম্ভীর। যেন এই বিয়ের ব্যাপারটি তার ভালো লাগছে না।
আমি বললাম, তোমার মনে হচ্ছে মন খারাপ?
না, মন খারাপ হবে কেন? আপনি কী-যে পাগলের মতো কথা বলেন! খুব রাগ লাগে।
আমি ঘরে ঢুকে দেখি আজিজ সাহেবের সামনে এক জন মোটাসোটা ভদ্রলোক বসে আছেন। ভদ্রলোকের মাথাভর্তি টাকা। একটা রুমাল দিয়ে তিনি ক্রমাগত মাথার টাক মুছছেন।
আজিজ সাহেব বললেন, এই যে শফিক, আস আসা। তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, এ হচ্ছে মতিনউদ্দিন। আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। আমেরিকার নর্থ ডাকোটাতে ছিল অনেক দিন। গত সপ্তাহে হঠাৎ এসে হাজির। দেখি না কাণ্ড। মতিনউদ্দিন-এ হচ্ছে আমাদের বাড়িওয়ালা, তবে আত্মীয়ের চেয়েও বেশি।
ভদ্রলোক মিহি সুরে বললেন, আপনার কথা অনেক শুনেছি।
আমি বড়োই অবাক হলাম। আমার কথা অনেক শোনার কোনো কারণ নেই। ভদ্রলোক বিদেশ থেকে ফিরে আজই হয়তো প্রথম এখানে এসেছেন। এই সময়ের মধ্যে আমার কথা শুনে ফেলবেন, সেটা ঠিক বিশ্বাস্য নয়।
আমি হাসিমুখে বললাম, কার কাছ থেকে শুনলেন?
নীলু বলল।
আমি অবাক হয়ে তোকালাম নীলুর দিকে। নীলুর এমন এক জন বয়স্ক মোটাসোটা লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকবে, তা ঠিক কল্পনা করা যায় না। নীলু রূপসী এবং অহংকারী। এই জাতীয় মেয়েরা মোটাসোটা টাকওয়ালা লোকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে না। ভদ্রলোক কৌতূহলী হয়ে বললেন, আপনি নাকি এক বার একটা কাক পুষেছিলেন? কাকটার নাম ছিল সম্রাট কনিষ্ক।
আমাকে মানতেই হল ভদ্রলোক আমার কথা আগেই শুনেছেন। প্রথম দিনই কেউ আমার কাক পোষার কথা জানবে, তা বিশ্বাস করা কষ্টকর।
নীলু আমাকে সব কিছু লিখিত চিঠিতে।
আমি ভালোভাবে তোকালাম ভদ্রলোকের দিকে। তাঁর চোখে-মুখে এমন একটি ছেলেমানুষী ভাব আছে, যা ছেলেমানুষদের মধ্যেও সচরাচর দেখা যায় না। ভদ্রলোক চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, কাকটা নাকি রাত-দিন আপনার পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করত। সত্যি?
আমার কাক পোষার ব্যাপারটির মধ্যে এতটা অতিরঞ্জন আছে, তা জানা ছিল না। ঘটনাটি খুলে বলা যাক।
কাকটির সঙ্গে আমার পরিচয় খুবই আকস্মিক। এক দিন সকালে নাশতা খাবার সময় সে রেলিংয়ের উপর এসে বসল। আমি যথারীতি একটি রুটির টুকরো ছুঁড়ে দিলাম। সে রুটির টুকরোটি স্পর্শও করল না। ঘাড় বাঁকিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় ডাকল কা—কা। খাবার স্পর্শ করে না, এই জাতীয় কাক আমি আগে দেখি নি-কাজেই অবাক হয়ে আরো কয়েক টুকরো রুটি ছুঁড়ে দিলাম। সে যেন আমাকে
বারান্দায়। সেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। শেষের দিকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকত রেলিং-এ। আমাকে দেখতে পেলেই গম্ভীর গলায় ডাকত কা-কা। আমাদের মধ্যে কথাবার্তাও হত। যেমন আমি যদি বলতাম, কি হে কনিক, শরীর তালো তো?
কা-কা।
তাঁর মানে ভালো নেই। হুঁ। হয়েছেটা কী?
কা কা কা (গম্ভীর আওয়াজ)।
কাদের মিয়ার এই কাক নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। তার ধারণা, এটা একটা অলক্ষণ। সে ঝাঁটা নিয়ে অনেক বার তাড়াতে চেষ্টা করেছে। লাভ হয় নি। ছাব্রিশে মার্চের পর এই কাকটিকে আর দেখা যায় নি। কোথায় গিয়েছে কে জানে?
মতিনউদ্দিন সাহেব বললেন, কাকটির নাম কনিষ্ক রাখলেন কেন? কনিষ্ক মানে কী?
কনিষ্ক হচ্ছে কুষাণ বংশের এক জন সম্রাট। ভারতে রাজত্ব করে গেছেন আনুমানিক ১০০ খ্রিষ্টাব্দে।
মতিনউদ্দিন সাহেব থেমে থেমে বললেন, নীলু ঠিকই বলেছে, আপনি ভাই অদ্ভুত লোক। নীলু রেগে গিয়ে বলল, আমি আবার কখন এই সব বললাম?
মতিনউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দুপুরে আমাকে ভাত খেতে হল। অন্যের বাড়িতে ভাত খেতে ভালো লাগে না। — গড়েই অস্বস্তি বোধ হয়। সেখানে ভাত মাখাতে হয় ভদ্রভাবে। লক্ষ রাখতে হয় ঠোঁটে ভাত লেগে আছে কিনা। হাত দিয়ে লবণ না নিয়ে চামচ দিয়ে নিতে হয়। সেই চামচটি আবার ধরতে হয় বা হাতে। আমি নিতান্ত প্রয়োজন না হলে অন্যের বাড়িতে খেতে বসি না। এখানেও নিতান্ত বাধ্য হয়ে বসতেই হল। যখন নীলুর মতো একটা মেয়ে নরম স্বরে বলে, আপনি না খেলে আমার খুব খারাপ লাগবে। আমি রানা করেছি আপনার জন্যেই। তখন অবাক হয়ে খেতে বসতেই হয়।
নীলু আমার সঙ্গে কথাটথা বিশেষ বলে না। মাসের প্রথম দিকে বাড়িভাড়ার টাকাটা খামে ভরে দিতে এসে টেনে টেনে বলে, টাকাটা গুনে নিন।
আমি সব সময়ই বলি, গুনতে হবে না, ঠিক আছে।
সে ঠাণ্ডা স্বরে বলে, না, গুনে নিন। আমাকে চোখ-মুখ লাল করে টাকা গুনতে হয়। রূপসী একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে টাকা গোনা বিড়ম্বনা বিশেষ। এক সময় সে বলে, ঠিক আছে তো?
ঠিক আছে।
মতিনউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে ভাত খেতে খেতে মনে পড়ল–এবার নীলু ভাড়া দিতে এসে টাকা গুনে নেবার কথা বলে নি। আমি যখন নিজ থেকে গুনতে যাচ্ছি, তখন বলেছে, শফিক সাহেব, আপনার যদি অস্বস্তি লাগে, তাহলে থাক–গুনতে হবে না। আমি গুনে এনেছি।