তা ঠিক। ঢাকা শহরে কানা-খোঁড়া—অন্ধ এরা বর্তমানে খুব নিরাপদ। হা-হা-হা।
আমি চুপ করে রইলাম।
রাগ করলে নাকি শফিক?
জ্বি-না।
ঠাট্টা করে বলি।
ঠিক আছে।
বড়ো আপা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, চা খাবি আরেক বার?
দুলাভাই বললেন, আমি খাব। আমাকে এক কাপ লেবু চা দাও।
বড়ো আপা কথা না বলে চলে গেলেন। দুলাভাই ক্লান্ত স্বরে বললেন, তোমার এক জন ভাড়াটে যে নিখোঁজ হয়েছিল, কী নাম যেন তার?
আব্দুল জলিল।
ও হ্যাঁ, জলিল। কোনো খোঁজ হয়েছে?
এখনো হয় নি। রফিককে নিয়ে চেষ্টা করছি।
তুমি খোঁজাখুঁজির মধ্যে যাবে না। কোনো ক্রমেই না। সময় ভালো না এখন। প্রায়ই লোকজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
করছে কী ওদের?
কিছু দিন রেখে ছেড়ে দিচ্ছে সম্ভবত। মানুষ মারা তো খুব কঠিন ব্যাপোর।
ধরাধরিটাই-বা করছে কি জন্যে?
মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেবার জন্যে। ভয় ধরানর এটা খুব ইফেকটিভ ব্যবস্থা। এক জন নিখোঁজ হলে পাঁচ হাজার লোক সেটা জানে। সবাই খোঁজাখুজি করে।
বড়ো আপা থমথমে মুখে চা নিয়ে ঢুকল। ওর বুদ্ধিসুদ্ধি সত্যি কম। চা এনেছে শুধু আমার জন্যে, দুলাভাইয়ের জন্যে নয়। তিনি একটু হাসলেন এবং হাসিমুখেই বললেন, শীলার জ্বর কমেছে? লুনাকে দেখলাম ওর ঘরে।
আপা জবাব দিল না।
ও কি আজকে থাকবে? এই সময় কেউ মেয়েদের বাইরে পাঠায়? কী আশ্চর্য!
আপা তারও জবাব দিল না।
আমি বললাম, মেয়েটি আজকে থাকবে দুলাভাই। শীলা ওর বাসায় টেলিফোন করে দিয়েছে।
মেয়েটিকে তুমি দেখেছি শফিক?
দেখেছি।
ওর চেয়ে সুন্দর মেয়ে তুমি দেখেছ?
আমি ইতস্তত করে বললাম, না।
আমি কিন্তু দেখেছি। ঢাকা কলেজে তখন পড়ি। বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেসে করে যাচ্ছি দিনাজপুরে। ময়মনসিংহ স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখি, একটি ষোল-সতের বছরের মেয়ে প্লাটফরমে টিনের একটা ট্র্যাঙ্কে বসে আছে। খুবই গরিব ঘরের মেয়ে। পায়ে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল।
আপা রাগী গলায় বলে উঠলেন, লুনার মধ্যে তুমি সুন্দরের কী দেখলে? সমস্ত মুখ ভর্তি নাক।
লুনার কথা তো আমি বলছি না। যার কথা আমি বলছি, তার নামধাম কিছুই জানি না।
আপা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। দুলাভাই হাসতে লাগলেন ঘর ফাটিয়ে।
আমি বললাম, ওদের কবে পাঠাচ্ছেন?
এই মাসেই পাঠাব। আমি নিজেও চলে যেতে পারি। রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় না। আরাম করে ঘুমুতে ইচ্ছা করে।
দুলাভাই গাড়ি করে আমাকে পৌঁছে দিতে রওনা হলেন। সাতটা মাত্র বাজে, এর মধ্যেই দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে লোক-চলাচল নেই। কেমন খী-খী করছে চারদিক। এত বড়ো একটা শহর বিম মেরে গিয়েছে।
দুলাভাই বললেন, সন্ধ্যার পর চলাফেরা করা ঠিক না।
দুলাভাই, আপনার কি ভয় লাগছে?
না, ভয় লাগে না। অন্য রকম লাগে। আমার কাছে টিক্কা খানের সই করা পাশ আছে, আমাকে কেউ ধরবে না।
গাড়ি সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছাকাছি আসতেই দেখি রোড ব্লক দিয়ে তিনচার জন সেপাই দাঁড়িয়ে। ওরা গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে কী-সব দেখছে। একটি কালো ভকস ওয়াগনকে দেখলাম রাস্তার পাশে। রোগামতো একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশে। একজন সেপাই কী-সব যেন জিজ্ঞেস করছে। দুলাভাই শুকনো গলায় বললেন, তুমি চুপচাপ থাকবে। কথাবার্তা যা বলবার আমি বলব।
ওরা আমাদের গাড়ি থামাল না। হোত ইশারা করে চলে যেতে বলল। তাকিয়ে দেখি দুলাভাইয়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
গেটের সামনে গাড়ি থামতেই জলিল সাহেবের স্ত্রীর কান্না শোনা গেল। আজ
সকাল-সকাল কান্না শুরু হয়েছে। দুলাভাই ভীত স্বরে বললেন, কাঁদে কে?
জলিল সাহেবের বউ।
রোজ এ রকম কাব্দে?
হ্যাঁ।
শফিক—
জ্বি।
তুমি খোঁজখবরের মধ্যে যাবে না। সময়টা খারাপ–দুলাভাই কুলকুল করে ঘামতে ল্যালেন।
আসেন, উপরে যাই। চা খেয়ে যান।
না থাক। দেরি হয়ে যাবে।
দেরি হবে না।
না থাক।
দুলাভাই না বলেও গাড়ি থেকে নেমে আমার সঙ্গে উপরে উঠতে লাগলেন।
শফিক, আমিও নীলগঞ্জে চলে যাব।
ভালোই হবে।
আমার ভালো লাগছে না। বড়োই দুঃসময়।
বিকালবেলা চুপচাপ
বিকালবেলা চুপচাপ ঘরে বসে আছি, কিছুই ভালো লাগছে না। সম্ভবত জ্বর আসছে। নিঃসন্দেহ হবার উপায় হচ্ছে সিগারেট ধরান। দুটি টান দিয়ে যদি ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়, তাহলে নির্ঘাত জ্বর আসছে। পরীক্ষাটা করবার উপায় নেই। সিগারেট ফুরিয়েছে। কাদের মিয়া আনতে গিয়েছে। কখন ফিরবে কে জানে!
আমি একটি চাদর গায়ে দিয়ে বারান্দায় বসলাম। বিলু এল সেই সময়। এই মেয়েটি নিঃশব্দে চলাফেরা করে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসার কোনো শব্দ আমি শুনি নি।
কী ব্যাপার বিলু?
আপনাকে বাবা ডাকছেন।
আমি তো যেতে পারব না, আমার জ্বর।
আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বিলু বলল, কই দেখি? বলেই সে হাত রাখল আমার কপালে। আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম।
জ্বর কোথায়! আপনার শরীর নদীর মতো ঠাণ্ডা।
নিজেকে সামলে নিয়ে সহজভাবে বলতে চেষ্টা করলাম, কি জন্যে ডাকছেন আমাকে?
কি জন্যে তা আমি কী করে বলব?
বিলু রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। এই মেয়েটি খুব অদ্ভুত। এমনি আমার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে হুঁ-হা করে জবাব দেয়। আবার কখনো আপনা থেকেই অনেক কথা বলে।
আজকে আমাদের ক্লাসে কী হয়েছে জানেন? নাজমা নামের একটা মেয়ে ফ্লাঙ্কে করে দুধ নিয়ে এসেছে, টিফিনের সময় খাবে। সেই দুধ আমরা ক্লাসের মধ্যে ঢেলে ফেললাম। তারপর কী হয়েছে জানেন?