পরীক্ষার ডেট দিয়েছে নাকি?
হুঁ, দৈনিক পাকিস্তানে আছে। দাঁড়া, নিয়ে আসছি, নিজের চোখে দেখ।
থাক আপা, আনতে হবে না।
না, তুই দেখে যা।
সারাটা দিন বড়ো আপার বাসায় কাটাতে হল। দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা না করে আসা ভালো দেখায় না। তিনি ফিরবেন ছাঁটার দিকে। এত দীর্ঘ সময় বড়ো আপার সঙ্গে কাটান একটি ক্লান্তিকর ব্যাপার। এক গল্পই তার কাছে অনেক বার শুনতে হয়। আজরফ কী করে কাপড়-ধোওয়া সাবান দিয়ে ধুয়ে তার একটি বেনারসী শাড়ি নষ্ট করেছে, সে-গল্প আমাকে চতুর্থ বারের মতো শুনতে হল। তারপর শুরু করল দুলাভাইয়ের এক বোনের গল্প। সেই বোনটি বিয়ের পর তার স্বামীর এক বন্ধুর সঙ্গে কী সব নটঘট করতে শুরু করেছে। এই গল্পটিও আগে শোনা।
আমি হাই তুলে বললাম, শীলা কোথায় আপা?
ওর বান্ধবী এসেছে।
যাই, দেখা দিয়ে আসি।
দরজা বন্ধ করে রেখেছে ওরা।
তাই নাকি?
হুঁ।
দরজা বন্ধ করার ব্যাপার নিয়েও বড়ো আপা গজগজ করতে লাগলেন।
দরজা বন্ধ করে কথা বলার দরকারটা কী? এই সব আমি পছন্দ করি না। মেয়েরা দরজা বন্ধ করলেই তাদের মাথায় আজেবাজে সব খেয়াল আসে।
শীলার বয়স এমন কিছু নয়। তের হয়েছে। বড়ো আপা বলেন সাড়ে এগার। অবশ্যি শীলাকে বেশ বড়োসড়ো দেখায়। এই তের বছর বয়সেই সে গোটা চারেক প্ৰেমপত্র পেয়েছে। এর মধ্যে একটি সে আমাকে দেখিয়েছে (আমার সঙ্গে তার বেশ ভাব আছে)। সেই চিঠিটি এতই কুৎসিত যে পড়া শেষ করে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়। আমি যখন বললাম, এই চিঠি তুই জমা করে রেখেছিস? ছিঁড়ে ফেলে দিস না কেন?
শীলা অবাক হয়ে বলেছে, আমার কাছে লেখা চিঠি আমি ফেলব কেন? জানো, লুনা একুশটা চিঠি পেয়েছে? এর মধ্যে একটা আছে। ষোল পাতার।
কী আছে সেই ষোল পাওয়ার চিঠিতে?
তোমাকে বলা যাবে না।
লুনা মেয়েটিই আজকে এসেছে। বড়ো আপা একে দুচক্ষে দেখতে পারে না। প্রধান কারণ হচ্ছে, মেয়েটি অসামান্য রূপসী। আমার ধারণা, এই মেয়েটির দিকে তাকালে যে-কোনো পুরুষের মনে তীব্র ব্যথাবোধ হয়। বড়ো আপা মুখ লম্বা করে বললেন, লুনার সঙ্গে অল্পবয়েসী মেয়েদের মিশতে দেয়া উচিত না।
আমি বলব না বলব না করেও বললাম, লুনাও তো অল্পবয়েসী।
বড়ো আপা আকাশ থেকে পড়ল, অল্প বয়েস কোথায় দেখলি তুই! দুই বছর আগে থেকে ব্রা পরে এই মেয়ে।
বিকালে চা দিতে এসে আজরফ গম্ভীর মুখে বলল, বড়ো রাস্তার মোড়ে একটা মিলিটারি জীপ।
আপা এটা শুনেই রেগে গেল। মিলিটারি জীপ হয়েছে তো কী হয়েছে? মিলিটারি তোকে খেয়ে ফেলেছে? গরু কোথাকার! যা আমার সামনে থেকে।
আজরফ সামনে থেকে নড়ল না। মুখ আগের চেয়েও গম্ভীর করে চা ঢালতে লাগল। আপা থমথমে গলায় বলল, মিলিটারি জীপ দেখেছিস, দেখেছিস। এর মধ্যে গল্প করার কী আছে? খবরদার, এই সব নিয়ে গল্পগুজব করবি না। আমি পছন্দ করি না।
আম্মা জীপটার লক্ষণ বালা না। এক জায়গার মধ্যে ঘুরাঘুরি করতাছে।
করুক। তারা তাদের কাজ করবে, তুই করবি তোর।
আইচ্ছা।
খবরদার, মিলিটারি নিয়ে আর কোনো কথা বলবি না।
আইচ্ছা।
আপার বক্তৃতা আজরফের মনে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। কারণ খানিকক্ষণ পর শীলা এসে বলল, আজরফ ভাই বলল রাস্তার মোড়ে একটা জীপ ঘোরাঘুরি করছে।
করুক, তাতে তোমার কী?
ওরা অল্পবয়সী মেয়েদের ধরে নিয়ে নেখটা করে একটা ঘরের মধ্যে রেখে দেয়।
বড়ো আপা স্তম্ভিত হয়ে বলল, কে বলেছে এই সব?
লুনা। লুনা বলল।
যাও, নিজের ঘরে যাও। যত আজগুবী কথাবার্তা। বলতে লজ্জাও করে না!
লজ্জা করবে। কী জন্যে? আমাকে তো আর নেংটো করে রাখে নি। শীলা ফিক করে হেসে ফেলল।
যাও, ঘরে যাও। তোমার বন্ধু যাবে কখন?
ও আজ থাকবে আমার সঙ্গে। বাসায় টেলিফোন করে দিয়েছি। মা, তুমি কিন্তু খিচুড়ি করবে রাত্রে। আমরা এখন জ্বর নেই।
ঠিক আছে, তুমি যাও। আজরফকে পাঠিয়ে দিও।
আপা দীর্ঘ সময় কোনো কথা বলতে পারল না। আজরফ যখন দ্বিতীয় বার চা দিতে এল তখন শুধু গম্ভীর হয়ে বলল, আজরফ, তোমার চাকরি শেষ। কাল সকাল নটায় বেতনটেতন বুঝে নিয়ে বাড়ি যাবে।
জ্বি আচ্ছা, আম্মা।
আজরফকে মোটেই বিচলিত মনে হল না, দিনের মধ্যে কয়েক বার যার চাকরি চলে যায়, তাকে চাকরি নিখে বিচলিত হলে চলে না।
দুলাভাই ঠিক ছটার সময় এলেন।
তাঁর সব কাজ ঘড়ি ধরা, সময় নিয়ে খানিকটা বাতিকের মতো আছে। পাঁচটায় কোথায়ও যাওয়ার কথা থাকলে চারটা পঞ্চাশে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন এবং ঠিক পাঁচটায় ঢুকবেন। অফিসের লোকরা তাঁকে ঘড়িবাবু বলে।
দুলাভাই আমাকে দেখেই বললেন, তিন ঠ্যাং-এর শালা বাবু যে? কী হেতু আগমন?
পা নিয়ে ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু দুলাভাইয়ের উপর আমি কখনো রাগ করতে পারি না। এই লোকটিকে আমি খুবই পছন্দ করি।
আছ কেমন শালা বাবু?
আমি হাসিমুখে বললাম, ভালো আছি, দুলাভাই।
তোমার তিন নম্বর ঠ্যাংটা সাবধানে রাখছ তো? খানায় পড়ার সম্ভাবনা। হা-হা-হা।
সাবধানেই রাখছি। আমাকেও হাসির ভান করতে হয়।
শুনেছি নাকি, ওদের নীলগঞ্জে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
শুনেছি।
তোমার আপার ধারণা, সে বনবাসে যাচ্ছে। তবে যে–পরিমাণ কান্নাজাটি করছে, সীতাও তার বনবাসে এত কাঁদে নি।
সীতার সঙ্গে তো রাম ছিল। কিন্তু আপনি তো যাচ্ছেন না।
আমিও যাব। ব্যাক টু দা ফরেস্ট। তবে কিছুদিন পর। তুমিও চল।
না দুলাভাই। এখানে আমার কোনো অসুবিধা নেই।