রফিকটার পড়াশোনা হয় নাই কুসঙ্গে থাকার জন্য। যত ছোটলোকের সাথে তার খাতির। তুমি আবার কিছু মনে করো না বাবা। তোমাকে কিছু বলছি না।
না খালা, মনে করার কী আছে।
আমি আবার মনের মধ্যে যা আসে বলে ফেলি।
এইটাই ভালো। বলে ফেলাই ভালো।
ঘর থেকে বের হয়ে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত এসে দেখি রফিক আসছে। হনাহন করে। তার দু হাতে দুটি প্রকাণ্ড বাজারের ব্যাগ। নিখোঁজ লোকদের কোথায় খুঁজতে হবে জিজ্ঞেস করা মাত্রই সে বলল, লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে থােক। আমি ব্যাগ দুটি রেখে আসছি।
আমরা গেলাম জনাব ইজাবুদ্দিন সাহেবের বাড়ি। ইজাবুদ্দিন সাহেব শান্তি কমিটির এক জন মেম্বার। হলুদ রঙের একটা দোতলা বাড়িতে থাকেন। বাড়ির নাম ভাই ভাই কুটির। নেমপ্লেটে লেখা এম. এ. (গোল্ড মেডালিষ্ট) এল-এল. বি.। রফিক বলল, লোকটার সবচেয়ে বড়ো গুণ হল–বিরক্ত হয় না। সব সময় হাসিমুখ।
কথা খুবই ঠিক। ইজাবুদ্দিন সাহেব মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন। খাতা বের করে নাম-ধাম লিখে রাখলেন এবং বললেন, মিলিটারি জেলে আছে কিনা সেখবর তিনি দু দিনের মধ্যে এনে দেবেন। যখন বেরিয়ে আসছি, তখন ইজাবুদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, আপনার বাবার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। বিশিষ্ট ভদ্রলোক ছিলেন তিনি। তাঁর বড়ো মেয়ের বিয়েতে আমি উপস্থিত ছিলাম। খাওয়াদাওয়া নিয়ে দারুন ঝামেলা হয়েছিল।
আমি বললাম, আমি এসে খোঁজ নিয়ে যাব।
না না, আপনার আসতে হবে না, আমি খবর দেব। বাড়ি আমি চিনি, কত বার গিয়েছি। শরিফ আদমী ছিলেন আপনার বাবা।
রফিককে ছেড়ে দিয়ে নিউমার্কেট পর্যন্ত চলে এলাম। হাঁটা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর। কিন্তু কোনো একটি বিচিত্র কারণে রিকশায় উঠলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে পারি না।
নিউ মার্কেটের সামনে একটি প্রকাণ্ড মিলিটারি ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। তিন-চার জন কালো পোশাক পরা মিলিটারি (নাকি মিলিশিয়া? কে যেন বলেছিল কালো পোশাকেরগুলি মিলিশিয়া–আরো ভয়ঙ্কর) জটিলা পাকাচ্ছিল। সবার চেহারা দেখতে এক রকম। এক জন একটু দূরে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা চুরুট টানছে। এর চেহারা অদ্ভুত সুন্দর। পাতলা পাতলা ঠোঁট, টানা চোখ, রাজপুত্রের মতো চেহারা।
এরা দাঁড়িয়ে থাকার জন্যেই এই দিক দিয়ে লোক চলাচল একেবারেই নেই। এক জন বুড়ো মতো মানুষ। শুধু একটি ওজনের যন্ত্র নিয়ে শুকনো মুখে বসেছিল। দুটি মিলিটারি ওকে কী সব জিজ্ঞেস করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। এক জন আবার দেখি, ওজনের যন্ত্রটায় উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি বিনা দ্বিধায় ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। মিলিটারি। আমাকে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে না। আইডেনটিটি কার্ড দেখতে চায় না। ছাত্র না। চাকরি করি, তাও জানতে চায় না। কারণ আমার ডান পাটি বাঁকা। আমি ডান দিকে ঝাঁকে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাঁটি। লাঠি দিয়ে শরীরের ভার অনেকটা সামলাতে হয়। আমার দিকে ওদের কোনো আগ্রহ নেই।
শারীরিক অক্ষমতা যে এমন একটি সুখকর ব্যাপার হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। আমাকে দেখে রাজপুত্রের মতো সেই মিলিটারিটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, ভালো আছেন?
ওজন-মাপা লোকটি অবাক হয়ে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি হাসিমুখে রাজপুত্রটিকে বললাম, আমি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো ভাই?
বড়ো আপা
বড়ো আপা আমাকে দেখেই বলল, তোর কথাই ভাবছিলাম।
কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা। কারো সঙ্গে দেখা হলেই সে এ-রকম বলে। তার ধারণা, এ ধরনের কথাবার্তায় খুব আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। তার আন্তরিকতা প্রকাশের আরেকটি কায়দা হচ্ছে ভাত খাওয়ার জন্যে সাধাসান্ধি করা। বিকাল চারটার সময় গেলেও সে গলা সরু করে বলবে, আজরফ মিয়া, টেবিলে ভাত দাও তো। তরকারি গরম কর। লেবু কাট। আর দেখা কাঁচামরিচ আছে কিনা।
আজকে অবশ্যি সে-রকম হল না। সে দেখলাম গম্ভীর হয়ে আছে। চোখ-মুখ ফোলা-ফোলা। বলাই বাহুল্য, দুলাভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। আমি সহজ ভাবে বললাম, ব্যাপার কি?
ব্যাপার-ট্যাপার কিছু না।
ঝগড়া হয়েছে নাকি?
নাহ।
তুমি গম্ভীর হয়ে আছ।
শীলার জ্বর। তোর দুলাভাইকে বললাম ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। সে নেবে। না। তার ধারণা, একটু গা গরম হলেই ডাক্তারের কাছে দৌড় দেওয়ার কোনো দরকার নেই।
জ্বর কি খুব বেশি?
সকালবেলা ১০২ পয়েন্ট পাঁচ ছিল। এখন ৯৯!
ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিয়েই কি ঝগড়া?
বললাম তো ঝগড়া কিছুই হয় নি। এক কথা বারবার জিজ্ঞেস করিস।
বড়ো আপা কাঁদতে শুরু করল। কান্না তার একটি রোগবিশেষ। যে-কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সে কেঁদে বুক ভাসাতে পারে। আমরা তার কান্নায় কখনো কোনো গুরুত্ব দিই না।
আপা কাঁদছ কেন?
তোর দুলাভাই আমাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। শহরের অবস্থা নাকি খুব খারাপ।
তোমার কাছে খারাপ মনে হচ্ছে না?
মনে হবে না কেন? তবে তোর আমার জন্যে তো কিছু না। আমরা হিন্দুও না, আমরা আওয়ামী লীগও করি না। আমাদের আবার কিসের অসুবিধা?
আমি চুপ করে রইলাম। বড়ো আপা থেমে থেমে বলতে লাগল, অবস্থা তো অনেক ভালো হয়েছে এখন। পরশু দিন আমি একা এক নিউমার্কেট থেকে বাজার করে আনলাম। আগে কাৰ্য্য ছিল নয়টা থেকে, এখন দশটা থেকে। ঠিক না? তুই বল?
তোর দুলাভাইয়ের ধারণা, গ্রামে গেলে আর কোনো ভয় নেই। এইখানে ভয়টা কিসের? পত্রিকায় দিয়েছে, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। অবস্থা খারাপ হলে দিত?