দিনটি মেঘলা। দুপুর থেকে টিপটপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। আমি নিচতলায় আজিজ সাহেবের ঘরের সামনে চুপচাপ বসে রইলাম। আজিজ সাহেব বা নেজাম সাহেব কারোর কোনো খোঁজখবর নেই। নেজাম সাহেবের নামে একটি রেজিষ্টি চিঠি অনেক দিন থেকে পড়ে আছে। লোকটি কোথায় আছে কে জানে?
ছোড ভাই, আপনের চা।
কাদের শুধু চা নয়, একটি পিরিচে দুটি বিঙ্কিটও নিয়ে এসেছে।
কী ব্যাপার, চা কেন?
ছোড ভাই, এই শেষ কাপ চা বানাইলাম।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
আর দেখা হয় কি না-হয়।
ব্যাপার কী।
আমি রফিক ভাইয়ের সাথে মেঘালয় যাইতেছি ছোড তাই।
কবে?
আইজই যাওনের কথা। কার্ফু তুললেই রওনা দেওনের কথা।
আগে বলিস নি কেন?
কাদের চুপ করে রইল। এক সময় মৃদু স্বরে বলল, কার্ফু ভাঙলেই আমি লুল আফার জন্যে ডাক্তারের ব্যবস্থা কইরা রফিক ভাইয়ের বাসায় যাইয়াম। এখন ডাক্তার পাইলে হয়।
তাকিয়ে দেখি, কাদের শার্টের হাতায় চোখ মুছছে।
বেলা সাড়ে-তিনটায় কাদের সত্যি চলে গেল। মতিনউদ্দিন সাহেব কিছুই জানেন না বলে মনে হল। আমাকে বললেন, কাদেরের কাণ্ড দেখেছেন, তিন ঘণ্টার জন্যে কার্ফু রিল্যাক্স করেছে–এর মধ্যেই তাকে বেরুতে হবে। কথা বললে তো শোনে না। শেষে একার জন্যে সবাই মারা পড়ব।
মতিনউদ্দিন সাহেব গম্ভীর হয়ে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। তাঁর দৃষ্টি কেমন যেন উদভ্ৰান্ত। আমি বললাম, আপনার কি শরীর ঠিক আছে?
জ্বি, ঠিক আছে।
দেখছেন কেমন ঢালা বর্ষণ শুরু হয়েছে?
জ্বি দেখলাম।
লুনা কি ঘুমাচ্ছে?
মতিন সাহেব হঠাৎ বললেন, মেয়েটার কাছে গিয়ে বসেন। ওর শরীর খুব খারাপ। সহজ স্বাভাবিক ভালোমানুষের মতো কথাবার্তা।
লুনা জেগে ছিল। জ্বরের আচে তার ফর্সা গাল লালচে হয়ে আছে। চোখ দুটিও ঈষৎ রক্তবর্ণ।
খুব বেশি খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ।
কাদের এক্ষুণি ডাক্তার পাঠাবে।
আপনি একটু বসবেন আমার কাছে?
আমি তার মাথার কাছে গিয়ে বসলাম। লুনা ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। আমার দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলল, একদিন সব আবার আগের মতো সবে, ঠিক না?
নিশ্চয়ই হবে, খুব বেশি দেরিও নেই।
সেই সময় আপনাকে আমাদের বাসায় কয়েক দিন এসে থাকতে হবে। মতিন সাহেবকে আর কাদেরকেও।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ভালোই হবে।
তখন কিন্তু হেন—তেন অজুহাত দিতে পারবেন না।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
আপনার থাকার ইচ্ছা নেই, হাসছেন মনে মনে।
অ্যারে না।
আর যখন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে, তখন কিন্তু আমি প্রায়ই আপনার এখানে বেড়াতে আসব।
তা তো আসবেই।
তখন আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতে হবে। তখন যদি আপনি মনে করেন যে বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে আমি কী কথা বলব। তাহলে খুব রাগ করব।
না, রাগ করতে দেব না।
আমি কিন্তু মোটেই বাচ্চা মেয়ে না। আমি অনেক কিছু জানি। ওকি, আপনি হাসছেন কেন?
কই, হাসছি কোথায়?
মনে মনে হাসছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি। যান, আপনার সঙ্গে কথা বলব না আমি।
লুনা ঝিম মেরে গেল। দীর্ঘ সময় কোনো কথাবার্তা বলল না। আমি চুপচাপ কাছে বসে রইলাম। কাদের কি ডাক্তারকে বলতে ভুলে গিয়েছে? ভোলবার কথা তো নয়।
লুনা সমস্ত দিন কিছুই খায় নি। আমি এক গ্লাস দুধ এনে দিলাম, সে তা স্পর্শও করল না। এক সময় গাঢ় রক্তবাণ চোখ মেলে বলল, কাদের এবং মতিন সাহেব এদের একটু ডেকে জিজ্ঞেস করুন তো ওরা আমাদের বাসায় থাকবে কিনা।
নিশ্চয়ই থাকবে।
তবু আপনি জিজ্ঞেস করুন।
মতিন সাহেবকে ডেকে আনলাম। লুনা জড়িত স্বরে বলল, আপনি কি থাকবেন আমাদের বাসায় কিছু দিন? থাকতে হবে। না বললে শুনব না।
মতিন সাহেব মুখ কালো করে বললেন, জ্বর মনে হয় খুব বেশি?
আমি বললাম, হ্যাঁ, অনেক বেশি। কাদের ডাক্তার পাঠাবে।
কখন পাঠাবো?
কার্ফু ভাঙার আগেই পাঠাবে।
লুনা বলল, কোনো ডাক্তার আসবে না। কেউ আসবে না আমার জন্যে।
ডাক্তার সত্যি সত্যি এল না। সন্ধ্যার আগে আগে বাদশা মিয়া এসে উপস্থিত। জানা গেল কাদের দু জন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, তাদের এক জন বলেছেন পরদিন সকালবেলায় আসবেন। অন্য জন বলেছেন হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
সন্ধ্যা ছটা থেকে আবার কার্য্য। লুনা আচ্ছন্নের মতো পড়ে আছে। মাঝেমাঝে বেশ সহজভাবে কথা বলে পরক্ষণেই নিজের মনে বিড়বিড় করে। এক বার খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ঠিক করে বলুন তো, আমার চেয়েও সুন্দরী কোনো মেয়ে দেখেছেন? আমাকে খুশি করবার জন্যে বললে হবে না। আমি ঠিক বুঝে ফেলব।
আমি চুপ করে রইলাম। লুনার মুখে আচ্ছন্ন।
চুপ করে থাকলে হবে না, বলতে হবে।
তোমার চেয়ে কোনো সুন্দরী মেয়ে আমি দেখি নি, লুনা।
সত্যি?
হ্যাঁ।
আমার গা ছুঁয়ে বলুন।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লুনার অবস্থা খুব খারাপ হল। মনে হল লোকজন ঠিক চিনতে পারছে না। মতিন সাহেব ঘরে ঢুকতেই বলল, আপনি আমার আম্মিকে একটু ডেকে দেবেন?
মতিন সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
ডেকে দিন না। বেশিক্ষণ কথা বলব না, সত্যি বলছি।
যাব। আপনি ওর কাছে বসে থাকুন। হাসপাতালে নিতে হবে।
মতিন সাহেবের ভাবভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। সহজ সাধারণ মানুষের মতো কাপড় পরলেন। বাদশা অবাক হয়ে বলল, কার্ফুর মইধ্যে যাইবেন?
হ্যাঁ।
আমি বললাম, সত্যি সত্যি বেরুচ্ছেন মতিন মাহেব?
হ্যাঁ। কাদের মুক্তিবাহিনীতে গেছে শুনেছেন?
শুনেছি।
বাদশা বলল–খুব নাকি কাঁদছিল। কাঁদার তো কিছু নেই, কী বলেন?
মতিনউদ্দিন সাহেব জুতো পায়ে দিতে—দিতে বললেন, দেখবেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।