খাওয়ার কিছু আছে শমসের মিয়া?
ঘর তো তালা দেওয়া, ছোট ভাই। চাবি মেমসাবের কাছে।
তোমার কাছে কিছু নাই?
মুড়ি আছে।
দাও দেখি। তেল মরিচ দিয়ে মেখে। চিঠিপত্র কী আছে দেখি।
চিঠি এসেছে অনুর কাছ থেকে। বড়ো আপার কাছে লেখা দীর্ঘ চিঠি (অনু আমাকে কখনো চিঠি লেখে না, নববর্ষের সময় কার্ড পাঠায়)। বড়ো আপার কাছে লেখা চিঠি আমার পড়তে কোনো দোষ নেই, এই চিন্তা করে চিঠি খুলে ফেললাম, চিঠি পড়ে বড়োই কষ্ট লাগল। এই যে, এত বড়ো একটা দুঃসময় যাচ্ছে আমাদের, সেই সম্পর্কে শুধু একটি লাইন লেখা, দেশের খবর শুনে খুব চিন্তা লাগছে, সাবধানে থাকবি। তার পরপরই তিন পৃষ্ঠা জুড়ে মন্টানা যাওয়ার পথে কী ঝামেলা হয়েছিল সেটা লেখা : আইডাহো ছাড়ার পাঁচ ঘণ্টা পর গাড়ির ট্রান্সমিশন গোল বন্ধ হয়ে। হাইওয়েতে দু ঘণ্টা বসে থাকতে হল। শেষ পর্যন্ত হাইওয়ে পেট্রল পুলিশ এসে রাত তিনটায় একটা অতি বাজে হোটেলে নিয়ে তুলল। পেটে প্রচণ্ড খিদে। ভেণ্ডিং মেশিনে আপেল আর মিল্ক চকোলেট ছাড়া কিছু নেই। বাধ্য হয়ে আপেল আর চকোলেট খেয়ে ঘুমাতে যেতে হল সবাইকে। আর ঘুম কি আসে? এয়ারকুলারটা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ।
শমসের মিয়া এক গামলা মুড়ি নিয়ে এল। কাঁচামরিচ যে কটা ঘরে ছিল, সবই বোধ হয় দিয়ে দিয়েছে। ঝালের চোটে চোখে পানি আসার যোগাড়। শমশের মিয়া গলা নিচু করে বলল, জায়গায়-জায়গায় নাকি যুদ্ধ শুরু হইছে, কথাডা সত্যি ছোট ভাই?
সত্যি। দেশ স্বাধীন হইলে গরিবদুঃখীর কোনো চিন্তা থাকত না, কী কন ছোট ভাই?
না থাকারই কথা।
খাওয়া–খাদ্য থাকব বেশুমার।
তা থাকবে।
খারাপের পরে বালা দিন আয়, এইটা বিধির বিধান।
খুবই খাঁটি কথা, শমসের মিয়া।
চিন্তা করলে মনটার মইদ্যে শান্তি হয়।
বাড়ি ফিরে শুনি লুনার চাচা আজকেও আসেন নি। লুনার জ্বরও বেড়েছে। কাদের এক জন ডাক্তার নিয়ে এসেছিল। ওষুধপত্র দিয়েছে আর বলেছে রক্ত পরীক্ষা করতে।
লুনা আমাকে দেখে বলল, কাউকে পান নি?
কাল ঠিক পাব। সকালেই গুলিস্তান থেকে বাস নিয়ে চলে যাব নারায়ণগঞ্জ।
আপনি যে সারা দিন ঘোরাঘুরি করেন, আপনার ভয় লাগে না?
নাহ, আমার অচল পা দেখেই মিলিটারিরা মনে করে, একে নিয়ে কোনো কামেলা হবে না।
লুনা গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি ভাবছেন আপনার কথা শুনে আমি হাসব? আমাকে যতটা ছোট। আপনি ভাবছেন, তত ছোট আমি না। আমি অনেক কিছু বুঝি।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। লুনা শান্ত স্বরে বলল, এই যে আমার কাল রাত থেকে জ্বর, আপনি কি আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছেন–কতটা জ্বর? আপনি কি মনে করেন, আমি জানি না কেন আপনি এ-রকম করছেন? আমি ঠিকই জানি।
কি জান?
লুনা থেমে থেমে বলল, গায়ে হাত দিলেই আমি অন্য কিছু ভাবব, বলেন, ভাবছেন না? আমি সব বুঝতে পারি। আমি যদি কালো, কুৎসিত একটা মেয়ে হতাম।–আপনি ঠিকই আমার গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখতেন। দেখেন টিকটিকি টিকটিক করছে, তার মানে সত্যি।
আমি লুনার কপালে হাত দিয়ে দেখি বেশ জ্বর গায়ে। স্বাভাবিক সুরে বললাম, লুনা তুমি শুয়ে থাক, আমি ভাত খেয়ে আসছি। আর তুমি যা বলেছ সেটা ঠিক। খুবই ঠিক।
রান্নাঘরে ঢুকতেই মতিনউদ্দিন সাহেব বললেন, খতমে জালালীটা শুরু করা দরকার। লুনার চাচা আসছে না। এদিকে আবার জ্বরাজ্বরি। এক লাখ পাঁচশ হাজার বার দোয়া ইউনুস পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। খুব শক্ত খতম এটা।
ভাত খেতে বসে শুনলাম দূরে কোথায় যেন গোলাগুলী হচ্ছে। থেমে থেমে বন্দুকের আওয়াজ। মতিন সাহেব মাখা ভাত রেখে উঠে পড়লেন। তাকিয়ে দেখি তাঁর পা ঠকঠক করে কাঁপছে। কাদের বলল, ভয়ের কিছু নাই। নিশ্চিন্ত মনে ভাত খান!
আমার খিদে নেই। বমি বমি লাগছে।
খানিকক্ষণ পর ভারি ভরি দুটি ট্রাক গেল। মতিন সাহেব ভীত স্বরে বললেন, সব বাতিটাতি নিভিয়ে ফেলা দরকার।
তিনি দিশাহারার মতো জানালা বন্ধ করতে ছুটলেন। কাদের বলল, লক্ষণ খারাপ ছোড ভাই।
রাত দশটায় হঠাৎ বাদশা মিয়া এসে হাজির। সে খুব একটা খারাপ খবর নিয়ে এসেছে। বিহারীরা দল বেঁধে লুটপাট শুরু করেছে। মানুষও মারছে। শুরু হয়েছে তাজমহল রোড, নূরজাহান রোড অঞ্চল থেকে। খবর সত্যি হলে খুবই চিন্তার ব্যাপার। কাদেরের মুখ শুকিয়ে গেল।
আমি বললাম, কোথেকে খবর পেয়েছিস?
ঠিক খবর স্যার। এক চুল মিথ্যা না।
লুনার ঘরে গিয়ে দেখি সে জেগে আছে। আমাকে দেখেই বলল, ঐ ছেলেটি কী বলছে?
না, কিছু না।
বলেন আমাকে, কী বলছে?
কোন জায়গায়?
শুরু হয়েছে মোহাম্মদপুরে।
মোহাম্মদপুর কত দূর এখান থেকে?
দূর আছে।
আপনি ঠিক করে বলেন। কেন আমাকে লুকাচ্ছেন?
বেশি দূর না।
বাদশা মিয়া থাকল না। কাৰ্য্য হবে দশটা থেকে। তার আগেই দরবেশ বাচ্চু ভাইয়ের ঘরে পৌঁছান দরকার। সেখানে পুরুষমানুষ কেউ নেই। বাচ্চু ভাইয়ের ছেলের বয়স মাত্র চার বছর।
আমরা বাতিটাতি নিভিয়ে সমস্ত রাত জেগে বসে রইলাম। মাঝরাতের দিকে সোবহানবাগের দিক থেকে খুব হৈ-চৈ ও চিৎকার শোনা গেল। এর কিছুক্ষণ পর একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় গুলীর শব্দ হতে লাগল। আমি দিশাহারা হয়ে গেলাম।
কাদের, কী করা যায়?
আল্লাহর নাম নেন ছোড ভাই। আল্লাহ্ হাফেজ।
লুনা কিছুতেই বিছানায় শুয়ে থাকতে রাজি হল না। অন্ধকার বারান্দায় আমাদের সঙ্গে সারা রাত বসে রইল। ভোর রাতে মাইকে করে বলা হল এই অঞ্চলে বিকাল তিনটা পর্যন্ত কার্ফ বলবৎ থাকবে।