না, আমার ভয় লাগছে না।
কাদের বলল, চিন্তার কিছু নাই আফা। কোনো বেচাল দেখলেই আমার কাছে খবর আসব। লোক আছে আমার আফা, আগের দিন। আর নাই!
কাদের যে এক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে উঠেছে, বেচাল দেখলেই তার কাছে খবর চলে আসবে।–তা জানা ছিল না। সে কয়েক দিন আগে ঘোষণা করেছে–এইভাবে থাকা ঠিক না। কিছু করা বিশেষ প্রয়োজন।
মতিন সাহেবের কাছে শুনলাম কাদের নাকি কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তারা তাকে নিয়ে যাবে। কখন নেবে, কি, তা গোপন। হঠাৎ এক দিন হয়তো চলে যেতে হবে। এই ব্যাপারে আমার সঙ্গে তার কোনো কথা হয় নি। সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বলার বোধহয় তার ইচ্ছাও নেই।
লুনা রাত দশটা বাজতেই ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল। আমি শুতে গেলাম রাত বারটার দিকে। শোয়ামাত্রই আমার ঘুম আসে না। দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে হয়। এপাশ-ওপাশ করতে হয়। দু-তিন বার বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে পানি দিতে হয়। বিচিত্র কারণে আজ শোওয়ামাত্রই ঘুম এল! গাঢ় ঘুম। ঘুম ভাঙল অনেক রাতে। দেখি অন্ধকারে উবু হয়ে বসে কাদের বিড়ি টানছে। আমাকে দেখে হাতের আড়ালে বিড়ি লুকিয়ে ফেলে নিচু গলায় বলল, মেয়েডা খুব কানতেছে ছোড ভাই। মনটার মইদ্যে বড় কষ্ট লাগতাছে।
প্রথম কিছুক্ষণ কিছুই শুনতে পেলাম না। তারপর অস্পষ্ট ফোঁপানির আওয়াজ শুনলাম। মেয়েটি নিশ্চয়ই বালিশে মুখ গুঁজে কান্নার শব্দ ঢাকার চেষ্টা করছে। আমি উঠে দরজার কাছে যেতেই কান্না অনেক স্পষ্ট হল। মাঝে-মাঝে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছে–আম্মি আম্মি। আমি কিছুই বললাম না! কিছু কিছু ব্যক্তিগত দুঃখ আছে, যা স্পর্শ করার অধিকার কারোরই নেই। মতিন সাহেব অনেকটা দূরে ইজিচেয়ারে মূর্তির মতো বসে ছিলেন, আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে ধরা গলায় বললেন, মেয়েটা খুব কাঁদছে। কী করা যায় বলেন তো?
কিছুই করার নেই।
তা ঠিক, কিছুই করার নেই। বড়ো কষ্ট লাগছে, আমিও কাঁদছিলাম।
বলতে—বলতে মতিন সাহেব চোখ মুছলেন। দু জন চুপচাপ বারান্দায় বসে রইলাম। একসময় কাদেরও এসে যোগ দিল। শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি পড়তে লাগল। জামগাছের পাতায় সড়সড় শব্দ উঠল। লুনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে ডাকল, আম্মি আমি। পরদিন লুনার চাচা লুনাকে নিতে এলেন না।
সন্ধ্যার পর মডার্ন ফার্মেসী থেকে টেলিফোন করতে চেষ্টা করলাম। অপারেটর বলল, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ নষ্ট। কখন ঠিক হবে তা জানে না। আমি বাসায় ফিরে দেখি লুনা মুখ কালো করে বসে আছে।
আমি বললাম, নিশ্চয়ই কোনো কাজে আটকা পড়েছেন। কাল নিশ্চয়ই আসবেন।
লুনা কোনো কথাটথা বলল না।
কালকে আমি তোমার খালার বাসা খুঁজে বের করব। চা খেয়েই চলে যাব। তোমার কাছে ঠিকানা আছে না?
জ্বি-আছে।
আমি খুব ভোরেই যাব। যদি এর মধ্যে তোমার চাচা চলে আসেন, তাহলে তুমি তাঁর সঙ্গে চলে যাবে। অবশ্যই যাবে। আমার জন্যে অপেক্ষা করবে না।
লুনা শান্ত স্বরে বলল, না। আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব।
আমার ফিরতে কত দেরি হবে, কে জানে। হয়তো আটকা পড়ে যাব রাস্তায়। তুমি অপেক্ষা করবে না। যত তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায় ততই ভালো।
রাত্ৰে ভাত খাওয়ার জন্যে ডাকতে গিয়ে দেখি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
আমি ভাত খাব না।
তোমার কি শরীর খারাপ লুনা?
জ্বি-না।
জ্বর না তো? চোখ-মুখ কেমন যেন ফোলা-ফোলা লাগছে।
জ্বরটর না। কিছু খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।
দুধ খাবে? ঘরে কলা আছে।
জ্বি-না। আমি কিছুই খাব না।
আমি ফিরে আসছি, হঠাৎ লুনা খুব শান্ত স্বরে বলল, আমার মনে হয় কেউ আমাকে নিতে আসবেন না।
শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একটি টিকটিকি ডাকল। লুনা বলল, দেখলেন তো, টিকটিকি বলছে ঠিক ঠিক। তার মানে কেউ আসবে না।
লাল রঙের তিল
ঠিকানা নিয়ে যে-বাড়িতে উপস্থিত হলাম সেটি তালাবন্ধ। গেটে টু লেট ঝুলছে। বাড়িওয়ালা আশেপাশেই ছিলেন, আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, বাড়ি ভাড়া করবেন? খুব সস্তায় পাবেন। সারভেন্টের জন্য আলাদা বাথরুম আছে। এখানে। গত বছর দেওয়াল ডিসটেম্পার করলাম।
বাড়িভাড়ার জন্যে আসি নি, খোরশেদ আলি সাহেবের খোঁজ করছি।–শুনে ভদ্রলোক খুব হতাশ হলেন।
এরা থাকে না। এখানে–জুন মাসে বাড়ি ছেড়ে গেছে। অঞ্চলটা নাকি নিরপাদ না। বলেন দেখি কোন অঞ্চলটা নিরাপদ? আমি তো এখানেই আছি, আমার কিছু হয়েছে? বলেন দেখি?
খোরশেদ আলি সাহেবরা এখন থাকেন কোথায় জানেন?
ঠিকানা আছে। গিয়ে দেখবেন, সেইখানেও নেই। নিরাপদ জায়গা যারা খোঁজে তারা এক জায়গায় থাকে না। ঘোরাঘুরি করে।
ভদ্রলোক ঠিকানা বের করতে এক ঘণ্টা লাগালেন। শেষ পর্যন্ত ঠিকানা যেটা পাওয়া গেল, সেটায় বাড়ির নম্বর দেওয়া নেই। লেখা আছে মসজিদের সামনের হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে বললেন, মসজিদের সামনেই বাড়ি, তাই মনে করেছে খুব নিরাপদ। বুদ্ধি নেই, লোক তো গাছে হয় না, মায়ের পেটেই হয়।
বহু ঝামেলা করে মসজিদের সামনের হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি খুঁজে বের করলাম। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের কথাই ঠিক। খোরশেদ আলি সাহেব এখানেও নেই। কোথায় গেছেন, তাও কেউ জানে না। বাসায় ফেরার পথে মনে হল, লুনার চাচা ভদ্রলোক হয়তো আমার ঠিকানাই হারিয়ে ফেলেছেন। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে সবচেয়ে জরুরী কাগজটা হারিয়ে ফেলা। ঠিকানা হারিয়ে ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বড়ো আপার বাসায় খোঁজাখুঁজি করছেন। অবশ্যি এ-যুক্তি তেমন জোরাল নয়। বড়ো আপার বাসায় দারোয়ান শমসের মিয়া আমার ঠিকানা খুব ভালো করে জানে। তবে এটা অসম্ভব নয় যে, শমসের মিয়াকে বিদায় দিয়ে নতুন লোক রাখা হয়েছে। খুব সম্ভব বিহারী কেউ। গাড়ির ড্রাইভার যেমন বিহারী রাখা হয়েছে সে-রকম। এযুক্তি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ায় আমি ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে বড়ো আপার বাসায় দুপুর দুটিার দিকে উপস্থিত হলাম। না, শমশের মিয়াই আছে এবং কেউ এবাড়িতে আসে নি। আসবার মধ্যে পিয়ন এসেছে।