আহ, আপনি কেন এত ভয় পাচ্ছেন? মাথা নিচু করে বসব কেন শুধু শুধু?
ড্রাইভার গাড়ি ছোটাচ্ছে ঝড়ের মতো। এত জোরে গাড়ি চালোনর দরকারটা কী? শুধু শুধু মানুষের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করা। আমি বললাম, ড্রাইভার সাহেব, একটু আস্তে চালান।
ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ফার্স্ট গিয়ারে নিয়ে এল, যা আরো সন্দেহজনক। যেই দেখবে, তারই মনে হবে বদ মতলব নিয়ে গাড়ির ভেতর কেউ বসে আছে, সম্ভবত একটি লুকান স্টেনগান আছে, সুবিধামতো টার্গেট পেলেই বের হয়ে আসবে।
বাড়ির সামনে এসেও আমার বুকের ধকধকানি কমে না। এত খাঁ-খাঁ করছে কেন চারদিক? আগে তো কখনো এ-রকম লাগে নি। আমি গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, এই কাদের–কাদের।
কাদেরের সাড়া পাওয়া গেল না। মতিনউদ্দিন সাহেব জানালা দিয়ে মাথা বের করে আবার কচ্ছপের মতো মাথা টেনে নিলেন। তার পরই বিপাং করে জানালা বন্ধ করে ফেললেন। ভদ্রলোকের মাথা কি পুরোপুরিই খারাপ হয়ে গেছে?
মতিন সাহেব, আপনি নিচে এসে সুটকেসটা নিয়ে যান দয়া করে।
মতিন সাহেব নিচে নামলেন না। শব্দ শুনে বুঝলাম ভদ্রলোক অন্য জানালাগুলি বন্ধ করছেন।
লুনা বলল, আমি নিতে পারব।
তোমার নিতে হবে না। রাখ তুমি। মতিন সাহেব, ও মতিন সাহেব।
কোনোই সাড়া নেই।
লুনা বলল, ঐ লোকটিরই কি মাথা খারাপ?
কে বলল তোমাকে?
শীলা। শীলা বলেছে।
শীলা দেখলাম অনেক কিছুই বলেছে। এই বাড়িতে যে একটা তক্ষক আছে, তাও তার জানা; দোতলায় উঠেই বলল, এ বাড়িতে নাকি কুমিরের মতো বড়ো একটা তক্ষক আছে?
তা আছে।
কোথায়, দেখান তো।
এই মেয়ে যে-অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় কেউ যে তক্ষকের খোঁজ করতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। আমি গম্ভীর মুখে লুনাকে বসিয়ে রেখে মতিন সাহেবের খোঁজ করতে গেলাম। তিনি ক্যান্দেরের ঘরে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
দরজা খোলেন মতিন সাহেব।
ঐ মেয়েটা কে?
আমার ভাগ্নি। আপনি দরজা বন্ধ করে বসে আছেন কেন?
মতিন সাহেব দরজা খুলে ফিসফিস করে বললেন, আপন ভাগ্নি?
তা দিয়ে দরকার কী আপনার?
মতিন সাহেব দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে বললেন, মেয়েটাকে আমি চিনি, শফিক সাহেব। আপনাকে আমি আগে বলি নি, এক দিন সন্ধ্যাবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটা মিষ্টি গন্ধ। তাকিয়ে দেখি, মাথার কাছে একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার নাকের কাছে একটা তিল। এইটি সেই মেয়ে। দেখেই চিনেছি।
আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই লোক তো বদ্ধ উন্মাদ।
মতিন সাহেব ফিসফিস করে বললেন, আপনার বিশ্বাস হয় না?
না। অন্ধকারের মধ্যে আপনি একটা মেয়ের নাকের তিল দেখবেন কী করে?
তাও তো ঠিক।
মেয়েটার নাকে কোনো তিল-টিল নেই, বিপদে পড়ে এসেছে, কাল সকালে চলে যাবে।
কী সর্বনাশ। রাত্রে থাকবে, আগে বলেন নি কেন?
আগে বললে কী করতেন?
না, মানে করার তো কিছু নেই।
যান, নিচে থেকে সুটকেসটা নিয়ে আসেন। কাদের গেছে কোথায়?
জানি না। আমাকে কিছু বলে যায় নি।
কখন আসবে, তাও বলে নি?
নাহ্।
লুনা অল্পক্ষণের মধ্যেই বেশ সহজ হয়ে গেল। কথাবার্তা বলতে শুরু করল। ভাবখানা। এ-রকম, যেন এ-জাতীয় ব্যাপার প্রতিদিন ঘটছে। অপরিচিত জায়গায় অপরিচিত পুরুষদের মধ্যে রাত কাটানটা তেমন কিছু বড়ো ব্যাপার নয়। নিজের বাবা-মার কথা এক বারই শুধু বলল। তক্ষকরা কী খায়, সেই গল্প বলতে বলতে হঠাৎ বলে ফেলল, আপনার কি মনে হয়, আরা-আম্মা ছাড়া পেয়ে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে? আমার ঠিকানা তো তারা জানে না।
প্রশ্নটি এত আচমকা এসেছে যে, আমার জবাব দিতে দেরি হল। আমি থেমে থেমে বললাম, খুবই সম্ভব। তবে তারা নিশ্চয়ই তোমার চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, আর তোমার চাচা তো আমার ঠিকানা জানেন।
তা ঠিক, এটি আমার মনেই হয় নি।
তার মুখ দেখে মনে হল বড়ো একটি সমস্যার খুব সহজ সমাধান পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই। আমি বললাম, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম কর। কাদের এসে এই ঘর তোমার জন্যে ঠিকঠাক করবে। চা খাবে? খিদে লেগেছে? ঘরে অবশ্যি কিছু নেই। শুধু শুধু চা এক কাপ খাও।
কে বানাবে চা, আপনি?
হ্যাঁ, কেন?
শীলা বলেছে আপনি কিছুই করতে পারেন না। চা পর্যন্ত বানাতে জানেন না! এই জন্যেই চাকরিটাকরি কিছুই করেন না। শুধু ঘরে বসে থাকেন।
আর কী বলেছে?
আর বলেছে আপনি কাক পোষেন। আপনি যে দিকেই যান, দশ-বারোটা কাক কা-কা করতে করতে আপনার পেছনে পেছনে যায়।
লুনা খিলখিল করে হেসে উঠল। বহুদিন আমার এই অগোছোল নোংরা ঘরে এমন মন খুলে কেউ হেসে ওঠে নি। আমার মনে হল, সব যেন আগের মতো হয়ে গেছে। আর ভয়ে ভয়ে রাস্তায় বের হতে হবে না। রাতের বেলা জীপের শব্দ শুনে কাঠ হয়ে বিছানায় বসে থাকতে হবে না। লুনা বলল, আপনি আবার রাগ করলেন নাকি?
কাদের এসে নিমেষের মধ্যে ঘরদের গুছিয়ে ফেলল। চাল-ডালের টিন দুটি কোথায় যেন সরিয়ে ফেলল। নতুন টেবিলক্লথ বের হল। বিছানার চাদর নিয়ে রমিজের দোকান থেকে ইন্ত্রি করিয়ে আনল। বইয়ের শেলফ গুছিয়ে, মতিন সাহেবকে নিয়ে ধরাধরি করে বড়ো ট্রাঙ্কটা সরান হল। এতে নাকি হাঁটা-চলার জায়গা বেশি হবে। এক ফাঁকে আমাকে এসে ফিসফিস করে বলে গেল, মেয়েছেলে না থাকলে ঘরের কোনো সুন্দর্য নাই। এই কথাটা ছোড ভাই খুব খাঁটি। লাখ কথার এক কথা।
লুনার থাকার ব্যবস্থা হল আমার ঘরে। আমি গেলাম কাঁদেরের ঘরে। মতিন সাহেব বললেন, তিনি বারান্দায় বসে থাকবেন। ঘরে একটি মহিলা আছে, সবাই ঘুমিয়ে পড়াটা ঠিক হবে না। তাঁর যখন এমনিতেই ঘুম হয় না, কাজেই অসুবিধা কিছু নেই। আমি লুনাকে বেশ কয়েক বার বললাম, ভয়ের কিছু নেই, একটা রাত দেখতে-দেখতে কেটে যাবে। আর যদি ভয়টয় লাগে, ডাকবে। আমার খুব সজাগ ঘুম।