বুঝলেন ছোড ভাই, সাপ গিলার অবস্থা হইছে। না পারে গিলতে না পারে রাখতে। কাদের পহেলা রমজানের জন্যে খুব উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। তার উৎসাহের প্রধান কারণ, দরবেশ বাচ্চু ভাই ছাড়া পাবে।
দরবেশ বাচ্চু ভাই ছাড়া পেলেন না। রমজানের সময় অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হল। আলবদর বাহিনী তৈরি হল। প্রথম বারের মতো অনুভব করলাম, কিছু কিছু যুদ্ধ সত্যি সত্যি হচ্ছে। নয়তো এতটা খারাপ অবস্থা হওয়ার কোনো কারণ নেই। ইজাবুদ্দিন সাহেবও অনেকখানি মিইয়ে গেলেন। বারান্দায় এখন আর তিনি এক শ পাওয়ারের বাতি দুটি জ্বালান না। ছয় রোজার দিন রাতে তারাবীর নামাজ শেষে ফেরবার পথে তিনি মারা পড়লেন। হাসিমুখে খবর আনল কাদের মিয়া। প্রচণ্ড ধমক লোগালাম কাদেরকে, এই লোকটার জন্য বেঁচে আছিস তুই কাদের। আর যেই হাসে হাসুক, তুই হাসিস না।
কাদেরের হাসি বন্ধ হল না। চোখ ছোট-ছোট করে বলল, খেইল শুরু হইছে। ছোড ভাই। বিসমিল্লাহ দিয়া শুরু।
মতিনউদ্দিন সাহেব শুধু বললেন, মানুষ মারাটা ঠিক না। মানুষ মারাটা কোনো হাসির জিনিস না কাদের মিয়া। ইজাবুদ্দিন সাহেব মানুষের অনেক উপকার করেছেন।
দুলাভাই খবর পাঠিয়েছেন এক্ষুণি যেতে হবে। দুলাভাইয়ের গাড়ির এই ড্রাইভারটি নতুন রাখা হয়েছে। লোকটি বিহারী। মিলিটারি গাড়ি থামালেই সে গলা বের করে একগাদা কথা হড়হড় করে বলে। ফলস্বরূপ গাড়ি থেকে নামতে হয় না।
দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি, জিনিসপত্র গোছগাছ হচ্ছে। আপার মুখে আষাঢ়ের ঘনঘটা। দুলাভাই বললেন, ইণ্ডিয়া যুদ্ধে নামবে, বুঝলে নাকি শফিক? শহর ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।
কখন ছাড়ছেন শহর?
আন্দাজ করা দেখি?
আজকেই যাচ্ছেন নাকি?
ঠিক। এক ঘণ্টার মধ্যে। গাড়িতে করে যাব ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহে খবর দেয়া আছে।
হঠাৎ করে যাচ্ছেন দুলাভাই! আজকেই ঠিক করলেন নাকি?
হ্যাঁ।
আজকে ঠিক করার পিছনে কোনো কারণ আছে?
আছে। সিরিয়াস কারণ আছে।
বলেন শুনি।
তার আগে বল, তুমি একটা কাজ করতে পারবে কিনা?
কী কাজ?
লুনাকে তো চেন, শীলার বান্ধবী–এক মেজর বিয়ে করতে চায় তাকে।
চিনি।
সেই মেয়েটিকে তোমার ওখানে নিয়ে রাখবে। শুধু আজকের রাতটা। কাল ভোরে মেয়ের এক চাচা এসে মেয়েকে নিয়ে যাবে। খবর দেওয়া হয়েছে, তাঁকে তোমার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি।
কিছুই বুঝতে পারছি না দুলাভাই। মেয়েটা কোথায়?
এইখানেই আছে। শীলার ঘরে আছে।
ব্যাপার মোটামুটি এই রকম, গত দশ দিন ধরে লুনা এই বাড়িতে আছে। মেয়ের বাবা-মা মেজর ভদ্রলোককে বলেছেন, মেয়ে চিটাগাং তার নানার বাড়িতে আছে। ঈদের পর আসবে। বিয়ের পাকা কথাবার্তা হবে তখন। মেজর সাহেব কিছুই বলেন নি। আজ সকালে কিছু লোকজন এসে মেয়ের বাবা-মাকে তুলে নিয়ে গেছে। দুলাভাইয়ের ধারণা, তাঁকে ধরতে আসবে আজকালের মধ্যে।
বড়ো আপা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, মেয়েকে আমার এখানে রাখার কথা তো আমি বলি নি, তোর দুলাভাই গলা বাড়িয়ে বলেছে। এখন দেখ না ঝামেলা।
ঝামেলা তো সবারই আপা। তুমি ঝামেলায় পড়লে দেখবে সাহায্যের জন্যে লোক আসছে।
রাখা রাখা। লম্বা লম্বা কথা ভালো লাগে না। লম্বা কথা অনেক শুনেছি।
বড়ো আপার ঢাকা ছাড়ার ইচ্ছা মোটেই নেই। তিনি আমার সামনেই এক বার দুলাভাইকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, সবচেয়ে ভালো হয়। এই বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথায়ও ওঠা।
শফিকের ওখানে উঠতে দোষ কী? ঘর তো খালি পড়ে আছে।
দুলাভাই অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, ঢাকা শহরে এক ঘণ্টার বেশি আমি থাকব না। ওরা আমাকে খুজছে।
তুমি তো শেখ মুজিব! তোমাকে না হলে ওদের ঘুম হচ্ছে না।
দুলাভাই শান্ত স্বরে ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি বের করতে। আমাকে বললেন, লুনাকে সবকিছু বলা হয়েছে, খুব শক্ত মেয়ে। একটুও ঘাবড়ায় নি।
আমি বললাম, যদি ওর চাচা না আসে?
আসবেই। আর যদি না-আসে, তাহলে তুমি বুদ্ধি খাটিয়ে যা করবার করবে। মেয়ের এক দূরসম্পর্কের খালা আছে। ঢাকায়। লুনার কাছে ঠিকানা আছে।
ওর বাবা-মার খবর ওকে বলেছেন?
কান্নাকাটি করছে না?
আমাদের সামনে না। মেয়ে বড়ো শক্ত, মাচকাবার মেয়ে না। আমি খুবই ইমপ্রেসড!
দুলাভাই খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একটা টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি, সেই টেলিফোন নাম্বারে ফোন করে বলবে যে আমি চলে গেছি।
কাকে বলব?
যে টেলিফোন রিসিত করবে, তাকেই বলবে। বলবে মেসেজ রাখতে।
এইটি কি আপনার ব্রিগেডিয়ার বন্ধুর নাম্বার?
হ্যাঁ, তোমার ওর কাছে যাওয়ার দরকার নেই।
টিকটিকি
লুনাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরছি।
রাস্তায় নেমেই প্রচণ্ড ভয় লাগল। মনে হল রাস্তাঘাটগুলি যেন বড়ো নির্জন। যেন আজকেই ভয়ংকর একটা কিছু ঘটবে। শাহবাগের পাশে প্রকাণ্ড একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল। তার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার বুক কাঁপতে লাগল। মনে হল ওরা আজ অবশ্যই আমাদের গাড়ি থামাবে। ঠাণ্ডা স্বরে বলবে, তোমার সঙ্গের ঐ মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করবার জন্যে আমরা নিয়ে যাব। আমি বলব, জনাব, ও একটি নিতান্ত বাচ্চা মেয়ে। ক্লাস নাইনে পড়ে। ওরা দাঁত বের করে হাসবে। এবং হাসতে হাসতে বলবে, জিজ্ঞাসাবাদ করবার জন্যে বাচ্চা মেয়েরাই ভালো।
আমি নিজেকে সাহস দেবার জন্যেই বললাম, লুনা, ভয়ের কিছু নেই। তুমি শান্তভাবে চুপচাপ বসে থাক।
চুপচাপই তো বসে আছি।
জানালা দিয়ে বারবার। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন? মাথাটা নিচু করে বস না।