কাদের সঙ্গে আমি তুই-তুই করে বলি। কোনো কারণে বিশেষ রেগে গেলেই শুধু তুমি সম্বোধন করি। কাদের তখন দারুণ নাৰ্ভাস বোধ করে।
কী কথা ছোড ভাই?
কি কথা বলবার আগেই নিচতলার তিন নম্বর ঘর থেকে কানার শব্দ শোনা যেতে লাগল। আজ এক মাস ধরে এই বাড়ির মেয়েটি কাঁদছে। এপ্রিল মাসের তিন তারিখ জলিল সাহেব বাড়ি ফেরেন নি। তাঁর স্ত্রী হয়তো রোজ আশা করে থাকে আজ ফিরবে। রাত এগারটা থেকে কাফিউ। এগারটা বেজে গেলে আর ফেরবার আশা থাকে না। মেয়েটি তখন কাঁদতে শুরু করে। মানুষের শোকের প্রকাশ এত শব্দময় কেন? যে-মেয়েটির কোনো কথা কোনো দিন শুনি নি, গভীর রাতে তার কান্না শুনতে এমন অদ্ভুত লাগে!
ছোড ভাই, জলিল সাবের এক ভাই আসছে আইজ।
তবে যে শুনলাম জলিল সাহেবের কোনো ভাই নেই।
চাচাত ভাই। মৌলানা মানুষ। বউ আর পুলাপানিটিরে নিতে আইছে।
কবে নেবো?
বউট যাইতে চায় না।
কেন যেতে চায় না?
কি জানি। মাইয়া মাইনসের কি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু আছে?
আমি চুপ করে রইলাম। কাদের মিয়া বলল, সময়ডা খুব খারাপ। কেয়ামত নজদিক।
ঘুমুতে গেলাম অনেক রাতে। বিছানায় শোবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দূরে কোথায়ও গুলীর শব্দ শোনা গেল। গুলীর শব্দ দিয়ে এখন আর ভয় দেখানর প্রয়োজন নেই। তবু ওরা কেন রোজ গুলী ছেড়ে কে জানে!
কাদের আমার পাশের ঘরে শোয়। তার খুব সজাগ নিদ্রা। সামান্য খটখট শব্দেও জেগে উঠে বিকট হাক দেয়–কেডা, কেডা শব্দ করে?
আজকেও গুলীর শব্দে জেগে উঠল। ভীত স্বরে বলল, শুনতাছেন ছোড় ভাই? কাম সাফ।
আমি জবাব দিলাম না। আমার সাড়া পেলেই ব্যাটা উঠে এসে এমন সব গল্প ফাঁদবে যে ঘুমের দফা সারা।
ছোড ভাই ঘুমাইছেন?
আমি গাঢ় ঘুমের ভান করলাম। লম্বা নিঃশ্বাস ফেললাম।
ছোড ভাই, ও ছোড ভাই।
কি?
মিত্যু সন্নিকট ছোড ভাই।
ঘুমা কাদের। বকবক করিস না।
আর ঘুম! বাঁচলে তো ঘুম। জীবনই নাই।
ঝামেলা করিস না কাদের, ঘুমা।
কাদের ঘুমায় না। বিড়ি ধরায়। বিড়ির কড়া গন্ধে বমি আসার যোগাড় হয়। চারদিক নীরব হয়ে যায়। জলিল সাহেবের স্ত্রীর কান্নাও আর শোনা যায় না। কিছুতেই ঘুম আসে না আমার। বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করি। এক বার বাথরুমে গিয়ে মাথা ধুয়ে এলাম। মাথার নিচে তিনটি বালিশ দিয়ে উঁচু করলাম। আবার বালিশ ছাড়া ঘুমুতে চেষ্টা করলাম। কিছুতেই কিছু হয় না। এক সময় কাদের মিয়া বলল, ঘুম আসে না ছোড ভাই?
না।
আমারো না। বড়ো ভয় লাগে।
ভয়ের কিছু নাই কাদের।
তা ঠিক। মৃত্যু হইল গিয়া কপালের লিখন। না যায় খণ্ডন।
কাদেরের সঙ্গে আমার কিছু কিছু মিল আছে। সে আমার মতোই ভীরু এবং আমার মতো তারও কঠিন অনিদ্রা রোগ।
সাড়ে তিনটার দিকে ঘুমের আশা বাদ দিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। কাদের মিয়া চায়ের জন্য কেরোসিনের চুলা ধরাল। চুলাটাও সে নিয়ে এসেছে বারান্দায়। আমার দিকে পিঠ দিয়ে আবার বিড়ি ধরিয়েছে।
নিচতলায়ও কে এক জন যেন সিগারেট ধরিয়েছে, বসে আছে জামগাছের নিচে–অন্ধকারে।
গাছ তলায় ওটা কে বসে আছে, কাদের?
কাদের কিছু না দেখেই বলল, নেজাম সাহেব।
বুঝলে কী করে নেজাম সাহেব?
নেজাম সাহেবেরও রাইতে ঘুম হয় না।
বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি ধরে গেল। ঝিমুনির মধ্যে মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, ভোরবেলা এক জন ডাক্তারের কাছে যাব। রাতের পর রাত না ঘুমানটা ভালো কথা নয়। বড়ো আপার বাসায়ও যেতে হবে। বড়ো আপা এর মধ্যে তিন বার খবর পাঠিয়েছে। জলিল সাহেবের ভাইয়ের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। তারাও যদি সত্যি সত্যি চলে যায়, তাহলে ভাড়াটে দেখা দরকার। ভাড়াটে পাওয়া যাবে না, বলাই বাহুল্য। শহর ছেড়ে সবাই এখন যাচ্ছে গ্রামে। কিন্তু বড়ো আপা এই সব শুনবে না। তাঁর ধারণা–ঢাকা শহরের চার ভাগের এক ভাগ লোক থাকার জায়গা পাচ্ছে না। রাত দিন টু লেট খুঁজে বেড়াচ্ছে।
চা হয়েছে চমৎকার। চুমুক দিয়ে বেশ লাগল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। চাঁদের স্নান আলো। শীত শীত হিমেল হাওয়া দিচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে দূরে কোথায়। মনটা হঠাৎ দারুণ খারাপ হয়ে গেল।
আজিজ সাহেবের সঙ্গে দেখা
সকালবেলা নিচে নামতেই আজিজ সাহেবের সঙ্গে দেখা।
আজিজ সাহেব বিলুনীলুর বাবা। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। চোখেও দেখতে পান না। পায়ের শব্দে মানুষ চিনতে পারেন। আমি পা ঘষটে ঘষটে বাড়ি ঢুকলেও তিনি চিকন সুরে ডাকবেন–কে যায়? শফিক না?
আজিজ সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়া একটি দুর্ঘটনা বিশেষ। দেখা হওয়ামাত্র তিনি বাড়ির কোনো একটি সমস্যার কথা তুলবেন–
কল দিয়ে পানি লিক করছে।
বসার ঘরে সুইচটা নষ্ট, হাত দিলেই শাক করে।
শোবার ঘরের একটি জানালার পুডিং উঠে গেছে, যে-কোনো সময় কাঁচ খুলে পড়বে।
যে-লোক চোখে দেখে না এবং সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে, সে এত সব লক্ষ করে কী করে, সে এক রহস্য। বাড়ির প্রসঙ্গ শেষ হওয়ামাত্র তিনি রাজনীতি নিয়ে আসেন। তাঁর রাজনীতিরও কোনো আগামাথা নেই। একেক দিন একেক কথা বলেন। রাজনীতির পরে আসে স্বাস্থ্যবিধি। পৃথিবীর যাবতীয় ব্যাধির কোনো-না–কোনো টোটকা তাঁর জানা আছে। জলাতঙ্ক রোগের একমাত্র অষুধ যে রসুনের খোসা, সেটি তাঁর কাছ থেকেই আমার শোনা।
সকালবেলা তাঁকে ধরাধরি করে বারান্দার ইজিচেয়ারে শুইয়ে দেওয়া হয়। দুপুর পর্যন্ত অনবরত ভ্যাজর ভ্যাজার করতে থাকেন। তিনি বারান্দায় থাকলে আমি পারতপক্ষে নিচে নামি না। আজকেও তিনি বারান্দাব্য ছিলেন না। পায়ের শব্দ শুনে শোবার ঘর থেকে ডাক দিয়েছেন কে, শফিক না? আসি তো দেখি এদিকে। বাথরুমের ফ্লাশটা থেকে ঘােসর ঘােসর শব্দ হয়। পানির কোনো ফ্লো নাই।