তুই আর এত রাত্রে যাবি কোথায়? থাক এখানে।
দরবেশ সাবের বাসাত একটা খবর দেওন দরকার।
সকালে দিবি, এখন আর যাবি কীভাবে? কাৰ্য্য না?
ছেলেটি মাথা চুলকাতে লাগল। বললাম, দরবেশ সাবের বাড়িতে আছে কে?
তাঁর পরিবার আছে। আর একটা পুলা আছে, নান্টু মিয়া নাম। খালি কান্দে।
তুই খাওয়াদাওয়া করেছিস?
জ্বি-না।
ভাত খা। এখন ঘর থেকে বার হওয়া ঠিক না।
কাদের মিয়াকে ধরে নিয়ে গেছে, এই খবরে আমি বিশেষ বিচলিত বোধ করলাম না। সহজ স্বাভাবিকভাবেই চা বানালাম। রাতের জন্যে কাদের কিছু রানা করে গেছে কিনা, তা দেখলাম হাঁড়ি-পাতিল উল্টে। ছেলেটার শোবার জায়গা দেখিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে কিছু গল্পগুজবও করলাম।
বাড়ি কোথায়?
বিরামছরি, ময়মনসিং।
বাড়িতে আছে কে?
মা আছে, ভইন আছে, দুইটা ভাই আছে। চাইর জন খানেওয়ালা।
বোনের বিয়ে হয়েছে?
হইছিল, এখন পৃথ্যক।
এক সময় বিলু এসে আমাকে নিচে ডেকে নিয়ে গেল। আজিজ সাহেবের জ্বর। তিনি কম্বল গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর সামনের চেয়ারে নেজাম সাহেব বসে আছেন। আমাকে দেখেই নেজাম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, কাদের মিয়াকে শুনলাম শুট করেছে।
ধরে নিয়ে গেছে। শুট করেছে। কিনা জানি না।
কী সর্বনাশের কথা ভাই! আজিজ সাহেব একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। থেমে থেমে বললেন, মনটা খুব খারাপ আজকে।
আমি চুপ করে রইলাম। বিলু বলল, আপনার খাওয়া হয়েছে?
না।
আপনার জন্য ভাত বাড়ছি। আমি এখনো খাই নি। নীলু আপাও খায় নি।
না, আমি খাব না। কাদের রোধে গিয়েছে।
তবু খেতে হবে।
নীলু বলল, ইনি খেতে চাচ্ছেন না, তবু জোর করছ, কেন?
না, খেতেই হবে।
আজিজ সাহেব বললেন, কাদেরের ব্যাপারে কী করবে?
করার তো তেমন কিছু নেই।
তা ঠিক।
আর কোনো কথাবার্তা হল না। বিলু এসে বলল, আসুন ভাত দিয়েছি।
আমি অস্বস্তির সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। ভাত খেতে গিয়ে দেখি, নীলু খেতে আসে, নি। তার নাকি মাথা ধরেছে।
বিলু বলল, মাথা ধরছে না হাতি, আমার সঙ্গে রাগ। আপনাকে খেতে বলেছি তো, তাই তার রাগ উঠে গেছে। তার রাগ করবার কী?
আমি চুপ করে রইলাম। বিলু বলল, সে অনেক কিছুই করে, যা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু আমি কি রাগ করি?
রাগ কর না?
মাঝে মাঝে করি, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিই না। আমার মুখ দেখে কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। এই যে কাদের বেচারা মারা গেল–
কাদের মারা গেছে বলছ কেন?
মিলিটারি ধরলে কি আর কেউ ফেরে? কেউ ফেরে না।
উপরে এসে দেখি, ছেলেটি তখনো ঘুমায় নি। বারান্দায় বসে আছে।
কি রে, ঘুমাস নি?
দরবেশ সাবের লাগি পেট পুড়ে।
পেট পুড়বার কিছু নাই। দেখবি সকালে ছেড়ে দেবে। মিলেটারির হাতে তো ধরা পড়ে নি। মিলিটারির হাতে ধরা পড়লে একটা চিন্তার কারণ ছিল।
ছেলেটা গম্ভীর হয়ে বলল, না স্যার, দরবেশ সবেরে আইজ রাইতেই গুলী করব।
দূর ব্যাটা, বলেছে কে তোকে?
আমার মনে আইতাছে স্যার। যোড়া আমার মনে অয় হেইড অয়।
বলে কী এই ছেলে! আমি সিগারেট ধরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকলাম তার দিকে।
দরবেশ সাবরে খাওন দিছে, না।–দিছে-না শেষ খানাটা বালা হওয়ন দরকার। কী কন স্যার?
কী বলছিস এইসব?
দরবেশ সাব আর জিন্দা নাই, স্যার।
আমি একটা কড়া ধমক লাগালাম। রাগী গলায় বললাম, দেখবি ভোরবেলা চলে এসেছে। দরবেশ মানুষ, তাকে খামাখা গুলী করবে কেন?
ইজাবুদ্দিন সাহেব আগের মতোই আমাকে খাতির-যত্ন করলেন। প্রায় দশ বার বললেন, আমার সাধ্যমতো খোঁজখবর করব। সন্ধ্যার মধ্যে ইনশাল্লাহ খবর বের করব।
ছাড়া পাবে তো?
যদি বেঁচে থাকে, তাহলে ইনশাল্লাহ ছাড়া পাবে।
বেঁচে না থাকার সম্ভাবনা আছে নাকি?
আছে শফিক সাহেব, সময় খারাপ। চারদিকে ঝামেলা, কারোর মাথাই ঠিক নাই।
কোনো খবর পেলে জানাবেন।
ইনশাল্লাহ জানাব। চিন্তা করবেন না। ফি আমানুল্লাহ।
আমি সন্ধ্যার সময় এসে খোঁজ নেব।
কোনো দরকার নাই। কষ্ট করবেন কেন খামাখা?
ইজাবুদ্দিন সাহেব আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, চীনা সৈন্যরা চলে আসছে, জানেন নাকি?
চীনা সৈন্য?
জ্বি, হাজারে হাজারে আসছে। যে-সব ফুটফাট শুনেন, সব দেখবেন খতম।
চীনা সৈন্য আসছে, এইসব বলল কে আপনাকে?
হা-হা-হা! খবরাখবর কিছু কিছু পাই। ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে খানা খেয়েছি। গত সপ্তাহে। খুব হামদদি লোক।
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, ইজাবুদ্দিন সাহেব।
জ্বি।
এই সব বিশ্বাস করবেন না। পাকিস্তানীদের অবস্থা খারাপ।
এইটা ভাইসাবে আপনি কী বললেন?
ঠিকই বললাম। আপনি নিজেও সাবধানে থাকবেন।
মাবুদে এলাহী, আমি সাবধানে থাকব কেন? আমি কী করলাম?
ইজাবুদ্দিন সাহেব কাজের লোক। বিকালবেলোয় খবর আনলেন, কাদের মিয়া, পিতা বিরাম মিয়া, গ্রাম কুতুবপুর, থানা কেন্দুয়া–জীবিত আছে। দু-এক দিনের মধ্যে ছাড়া পাবে। তবে দরবেশ বাঙ্গু ভাই নামে কেউ ওদের কাস্টডিতে নেই। এই নামে কোনো লোককে আটক করা হয় নি।
দু দিনের জায়গায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল, কাদের ফিরল না। আমি রোজই এক বার যাই ইজাবুদ্দিন সাহেবের কাছে! ভদ্রলোকের ধৈর্য সীমাহীন–একটুও বিরক্ত হন না! রোজই বলেন, বলছি তো ছাড়া পাবে। সবুর করেন। আল্লাহ্ দুই কিসিমের লোক পছন্দ করে, এক–যারা নেক কাজ করে, দুই–যারা সবুর করে। সবুরের মতো কিছু নাই।
কাদেরের অনুপস্থিতিতে আমার খাওয়াদাওয়া হয় নিচতলায় নেজাম সাহেবদের ওখানে। ওদের একটি কাজের মেয়ে রানা করে দিয়ে যেত। এখন আর আসছে না। এখন রান্না করছেন মতিনউদ্দিন সাহেব। চমৎকার রান্না। দৈনন্দিন খাবারের ব্যাপারটি যে এত সুখকর হতে পারে, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। অবশ্য নেজাম সাহেব প্রতিটি খাবারের কিছু-না-কিছু ত্রুটি বের করেন।