আপা সরু গলায় বলল, তোকে কে বলেছে?
দুলাভাইয়ের কাছে শুনলাম।
তোর দুলাভাইকে নিয়ে মুশকিল। পেটে কথা থাকে না। শুধু লোক-জানাজানি করা, আর মানুষকে বিপদে ফেলা!
আপা রাগে গজগজ করতে লাগল। আমি জানলে কী-রকম বিপদ হতে পারে, তা বুঝতে পারলাম না। আপার কথাবার্তার কোনো ঠিকাঠিকানা নেই। যখন যা মনে আসে বলে। সব মেয়েরাই এ-রকম নাকি? আপা ভ্রূ কুচকে বলল, জন্মদিন ভেবে আসিস নি, তো কী ভেবে এসেছিস? তোর তো দেখাই পাওয়া যায় না।
টিক্কা খান মারা যাওয়ার পর দুলাভাইয়ের পরিকল্পনা কিছু বদলেছে কি না। জানিবার জন্যে আসলাম।
টিক্কা খান মারা গেছে, তোকে বলল কে?
মারা যায় নি?
টিক্কা খান কি মাছি যে থাবা দিয়ে মেরে ফেলবো?
আপা কোনো এক বিচিত্র কারণে পাকিস্তানী মিলিটারি মারা পড়ছে–এই জাতীয় খবর সহ্য করতে পারে না। আমি আপার রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করলে সঠিক জানা যেত।
আমি যে বললাম, সেটা বিশ্বাস হল না?
রাত্রে আমাকে থেকে যেতে হল। দুলাভাই আমাকে গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিতে রাজি হলেন না, আবার এক-একা ছাড়তেও চাইলেন না। বড়ো আপার বাসায় আমার রাত কাটাতে ভাল লাগে না। এখানে রাত কাটানর মানেই হচ্ছে সারা রাত বসার ঘরে বসে বড়ো আপা যে কী পরিমাণ অসুখী, সেই গল্প শোনা। দুলাভাই ঠিক দশটা ত্ৰিশ মিনিটে, তুমি তোমার দুঃখের কাহিনী এখন শুরু করতে পার এই বলে দাঁত মাজতে যান এবং দশটা পয়ত্ৰিশে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েন। আপার দুঃখের কাহিনী অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় না। দুলাভাই ঘুমিয়ে পড়েছেন কি না, সেই সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জ:নো ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করে আকবরের মাকে চা আনতে বলে, তারপর গলার স্বর যথাসম্ভব নিচে নামিয়ে বলে, শফিক, জীবনটা আমার নষ্ট হয়ে গেছে। তুই তো বিশ্বাস করবি না। তোর দুলাভাই একটা অমানুষ।
কী যে তুমি বল আপা!
কী বলি মানে? তুই কি ভেতরের কিছু জানিস? তুই তো দেখিস বাইরেরটা।
বাদ দাও, আপা।
বাদ দেব কি? বাদ দেওয়ার কিছু কি আছে? তুই কি ভাবছিস আমি ছেড়ে দেব? নীপু যদি না ছাড়ে, আমিও ছাড়ব না।
নীপু আমার মেজো বোন। গত পনের বছর ধরে সে আমেরিকার সিয়াটলে থাকে। গত বৎসর খবর এসেছে, সে সেপারেশন নিয়ে আলাদা থাকে। আমি আপাকে বললাম, নীপুর সঙ্গে তুলনা করছ কেন?
কেন তুলনা করব না? নীপু কি আমার চেয়ে বেশি জানে না নীপুর বুদ্ধি আমার চেয়ে বেশি? সে যদি সেপারেশন নিতে পারে।–আমিও পারি। তুই কি ভাবছিস, আমি এমনি ছেড়ে দেব? ওর বাপের নাম ভুলিয়ে দেব না?
যেহেতু নীপু সেপারেশন নিয়েছে, কাজেই আপার ধারণা হয়েছে সেপারেশন নেবার মধ্যে বেশ খানিকটা বাহাদুরি আছে।
আজ রাত্রে বড়ো আপা তার দুঃখের কাহিনী শুরু করবার সুযোগ পেল না। ঘড়িতে এগারটা বাজল, তবু দুলাভাই ওঠবার নাম করলেন না।
আপা বলল, ঘুমাবে না?
নাহ।
শরীর খারাপ?
নাহ, শরীর ঠিক আছে।
শরীর ঠিক থাকলে ঘুমাতে যাচ্ছ না কেন? তোমার তো সব কিছ ঘড়ির কাটার মতো চলে।
এই নিয়েও তুমি একটা ঝগড়া শুরু করতে চাও?
আমি বুঝি সব কিছু নিয়ে ঝগড়া করি?
তা কর। আমি যদি এখন একটা হাঁচি দিই, এই নিয়েও তুমি একটা ঝগড়া শুকান করবে।
তুমি হাঁচি দিলেই ঝগড়া শুরু করব!
প্রথমে ঝগড়া, তারপর কানাকাটি, তারপর খাওয়া বন্ধ।
বড়ো আপা মুখ কালো করে উঠে চলে গেল! দুলাভাই হোহো করে হোসে উঠলেন।
কফি খাওয়া যাক। শফিক খাবে?
না, কফি ভালো লাগে না। চা হলে খেতে পারি।
আমি নিজে বানাচ্ছি, খেয়ে দেখ। খুব সাবধানে লিকার বের করব। সবাই পারে না, খেলেই বুঝবে।
দুলাভাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই দক্ষিণ দিকে প্রচণ্ড একটা আওয়াজ হল। সমস্ত অঞ্চল অন্ধকার হয়ে পড়ল। দুলাভাই থেমে থেমে বললেন, খুব সম্ভব ট্রান্সমিশন স্টেশনটি শেষ করে দিয়েছে।
শীলা ঘুম থেকে উঠে। চিৎকার করতে লাগল। ঘণ্টা বাজিয়ে কয়েকটা দমকলের গাড়ি ছুটে গেল। গুলীর আওয়াজ হল বেশ কয়েক বার। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কয়েকটি ভারি ট্রাক জাতীয় গাড়ি গেল।
আমরা সবাই শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। আমার জানা মতে সেটিই ছিল ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর প্রথম সফল আক্রমণ।
দরবেশ বাচ্চু ভাই
দরবেশ বাচ্চু ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে।
বাচ্চু ভাই একা নয়, তার চায়ের দোকানে রাত নটার সময় যে কজন ছিল, সবাইকে। আমাদের কাদের মিয়া তাদের এক জন। এত রাত পর্যন্ত সে বাইরে থাকে না। রাত আটটায় বি বি সির খবর। এর আগেই সে আজিজ সাহেবের ঘরে উপস্থিত হয়। সেদিনই শুধু দেরি হল।
যে-ছেলেটি খবর দিতে এল সে দরবেশ বাঙ্গু ভাইয়ের দোকানের বয়। দশএগার বছর বয়স। তাকেই শুধু ওরা ছেড়ে দিয়েছে। তার কাছে জানা গেল রাত নটার কিছু আগে দু-তিন জন লোক এসেছে দোকানে। লোকগুলি বাঙালী। এদের মধ্যে এক জন বেটেমতো-মাথার চুল কোঁকড়ান। সে বলল, বাচ্ছ ভাই এখানে কার নাম?
বাচ্চু ভাই কাউন্টার থেকে উঠে এলেন।
আমার নাম। কী দরকার?
একটু বাইরে আসেন।
ওরা বাচ্চু ভাইকে বাইরে নিয়ে একটা গাড়িতে তুলল। তারপর এসে বাকি সবাইকে বলল, জিজ্ঞাসাবাদ করবার জন্যে থানায় নিয়ে যাচ্ছি। ভয়ের কিছু নাই।
আমি ছেলেটিকে বললাম, দোকানে তালা দিয়ে এসেছিস?
হ স্যার। ক্যাশ বাক্সের টেকাও আমার কাছে।
কত টাকা?
মোট তেত্রিশ টাকা বার আনা।