কী খবর?
টিক্কা মারা গেছে।
কে খবর দিয়েছে? আমাদের কাদের মিয়া তো?
খবর দেওয়াদেওয়ির কিছু নেই শফিক! সবাই জানে। আমরা জানলাম সবার শেষে।
আজিজ সাহেব আকাশবাণী ধরে বসে আছেন। এরা খবর দিতে এত দেরি করছে কেন বুঝতে পারছি না। তারা শুধু বলেছে।–ঢাকা থেকে প্রচণ্ড গণ্ডগোলের খবর নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া গেছে। বি বি সি দিনের বেলা পরিষ্কার ধরা যায় না, রাত না হওয়া পর্যন্ত সঠিক কী ঘটেছে, তা জানা যাবে না। নেজাম সাহেব বললেন, তিনি অফিসে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিলেন, অবস্থা বেগতিক দেখে চলে এসেছেন। দোকানপাট যেগুলি খুলেছিল সে-সব বন্ধ করে লোকজন বাড়ি চলে গেছে। রাস্তাঘাটে রিকশার সংখ্যাও নগণ্য। মদপুর রোডে চেকপোস্ট বসেছে। রিক্সা-গাড়ি সব কিছুই থামান হচ্ছে।
আজিজ সাহেব বললেন, কলিজা শুকিয়ে শুকনা কাঠ হয়ে গেছে শফিক। বাঙালী তো চিনে নাই। এখন চিনবে। ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখে নাই।
আমাকে তারা কিছুতেই বের হতে দিল না। আজিজ সাহেব বললেন, আজকের দিনটা খুব সাবধানে থাকা দরকার। ওরা পাগলা কুত্তার মতো হয়ে আছে তো, কী করে না-করে কিছুই ঠিক নাই।
দুপুরের আগেই কী করে এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটল, তা জানা গেল। জেনারেল টিক্কা খান ফাইলপত্র সই করছিলেন। এমন সময় তাঁর ইউনিটের এক জন বাঙালী অফিসার (সে-ই একমাত্র বাঙালী, যে এখনো টিকে আছে এবং পাক আমির কথামতো সমানে বাঙালী মারছে) জেনারেল টিক্কার ঘরে ঢুকাল। তাদের মধ্যে ইংরেজিতে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল।
টিক্কা : কী ব্যাপার কর্নেল মইনা? এত রাত্রে কোনো প্রয়োজন আছে?
মইন : জ্বি স্যার, আছে।
টিক্কা : বেশ, বলে ফেল। আমার হাতে সময় কম। আমি খুবই ব্যস্ত।
মইন : আপনার সময় কম, কথাটি স্যার সত্যি।
এক পর্যায়ে কর্নেল মইন (নামের ব্যাপারে খানিকটা সন্দেহ আছে। কেউ কেউ বলছে মেজর সাঈদ) রিভলবার বের করে পরপর তিনটে গুলী করলেন।
মতিনউদ্দিন সাহেবকে দেখে মনে হল তিনি কিছুটা দিশাহারা, যেন বুঝতে পারছেন না ঠিক কী হচ্ছে। আমাকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে নিচু স্বরে বললেন, টিক্কা সাহেবকে অন্যায়ভাবে মারাটা ঠিক হল না।
আমার বদ্ধমূল ধারণা, মতিনউদ্দিন সাহেবের মাথায় ছিট আছে। এখন তিনি নেজাম সাহেবের সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ান। যেখানে তিনি আছেন, সেখানেই মতিন সাহেব আছেন। কন্দেরের কাছে শুনলাম, নেজাম সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও নাকি ভূত দেখেছেন। সন্ধ্যাবেল বারান্দায় বসে ছিলেন, সড়সড় শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখেন, জামগাছের ডালে কে যেন বসে আছে। কোনোদিকে কোনো বাতাস নেই, শুধু জামগাছের ডালটি নড়ছে! মতিন সাহেবকে দেখি সব সময় ঘরেই থাকেন। চাকরিবাকরি কিছুই করবেন না নাকি? জিজ্ঞেস করলেই হাঁ-হাঁ করেন, পরিষ্কার কিছু বলেন না।
টিক্কা খানের মৃত্যুপ্রসঙ্গে আমার যা-কিছু অবিশ্বাস ছিল, বিকালের দিকে তা ধুয়ে-মুছে গেল। বড়ো আপার বাসায় যাবার জন্যে বেরিয়েছি, দেখি সত্যি সত্যি খুব থমথমে অবস্থা। দোকানপাট বেশির ভাগই বন্ধ, লোকজন। এখানে-ওখানে জটিল পাকাচ্ছে। ই পি আর হেড কোয়ার্টারের গেটের সামনে বালির কস্তা ফেলে দুর্গের মতো করা। বালির বস্তা আগেও ছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যুদ্ধের সাজসজ্জা! সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে মেশিনগান বসান দুটি কালো রঙের জীপ। সায়েন্স লাবরেটরি থেকে রিকশা নিয়ে চলে গেলাম মগবাজারে। রিকশাওয়ালাটি বৃদ্ধ। টানতে পারে না। পাক মটরস পর্যন্ত যেতেই তাকে তিন বার থামতে হল! যতক্ষণ থেমে থাকে, ততক্ষণ সে আমাকে খুশি রাখবার জন্যেই হয়তো গল্পগুজব করে। তার কাছ থেকেই জানলাম।–জেনারেল টিক্কা একা মারা যায় নি। তার বউ এবং ছেলেটাও মারা গেছে।
গুষ্টি নিকাশ হইছে স্যার। নিব্বংশ হইছে।
আমি বললাম, খবর কোথায় পেলেন চাচা মিয়া?
সে গম্ভীর হয়ে বলল, এই সব খবর কি স্যার গোপন থাকে? মুক্তিবাহিনীর লোক শহরে ঢুকছে। লাড়াচাড়া শুরু হইছে।
কী লাড়াচাড়া?
যাত্ৰাবাড়িতে দুইটা ট্রাক উড়াইয়া দিছে। হেই রাস্তায় দুই দিন ধইরা লোক চলাচল বন্ধ।
যাত্ৰাবাড়ির দিকে গেছিলেন নাকি?
কী যে কন! উদিকে কেউ যায়?
আমাকে দেখে বড়ো আপা বললেন, তুই আবার আসলি কী জন্যে? এই বৎসর আর জন্মদিনটিন কিছু করছি না।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। দুলাভাই বললেন, তুমিও আবার জন্মদিনটিন মনে রাখ নাকি, শফিক? আমার নিজেরও কিন্তু মনে নাই। হা-হা-হা। গিফটটিফট কিছু আছে সঙ্গে, না খালি হাতে এসেছ?
তখন আমার মনে পড়ল, আজ জুলাইয়ের ৬ তারিখ–শীলার জন্মদিন। বড়ো একটা উৎসবের তারিখ।
তোর জন্যে সকালেই গাড়ি পাঠােতাম। তোর দুলাভাই বলল অবস্থা থমথমে, তাই পাঠাই নি! তুই আবার জন্মদিনের জন্যে চলে আসলি? ঘর থেকে বার হওয়াই তো এখন ঠিক না।
আমি ইতস্তত করে বললাম, জন্মদিন ভেবে আসি নি। জন্মদিনটিন আমার न् शंका न्।
আপা তার স্বভাবমতো সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল। দুলাভাই ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন।
দিলে তো তোমার আপাকে রাগিয়ে। জন্মদিন ভেবে আস নি, এটা বড়ো গলা করে বলার দরকার কী? তুমি দেখি ডিপ্লেমেসি কিছুই শিখলে না। হা-হা-হা।
জন্মদিনের কোনো আয়োজন হয় নি, কথাটা ঠিক নয়। কিছুক্ষণ পরই দেখলাম শীলার বান্ধবীরা আসতে শুরু করেছে। এরা আশেপাশেই থাকে। এদেরকে বলা হয়েছে। লুনা মেয়েটি একটি গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরে এসেছে। তুলিতে আৗকা ছবির মতো লাগছে মেয়েটিকে। আমি আপাকে বললাম, এই মেয়েটির যে এক মেজরের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে?