মগবাজারে বড়ো আপার বাসায় গিয়ে দেখি তাদের যাওয়া বাতিল হয়ে গেছে। বড়ো আপা মহাখুশি। কাপড়াচোপড় সুটকেস থেকে নামান হচ্ছে। বেশ একটা খুশি খুশি ব্যস্ততা।
তোমাদের যাওয়ার কী হল?
তোর দুলাভাইকে জিজ্ঞেস কর, আমি কিছু জানি না।
দুলাভাই ঠিক পরিষ্কার করে কিছু বলেন না। তার হাবভাবে মনে হল অবস্থা যতটা খারাপ মনে করেছিলেন, ততট, খারাপ নয়। এক দিনে অবস্থা হঠাৎ করে কীভাবে ভালো হয়ে গেল, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
এক ফাঁকে বড়ো আপা বললেন–তাঁরা তাজমহল রোডের বিজলী মহল্লায় একটা চারতলা বাড়ি কিনবেন। পঁচানব্বই হাজার টাকা দিলেই পাওয়া যায়। যে-অবাঙালীর বাড়ি, সে পাকিস্তান চলে যাবে।–কাজেই জলের দরে সব কিছু বিক্রি করে দিচ্ছে। দেশের অবস্থা ভালো হলে ঐ লোককে জলের দরে সব কিছু বিক্রি করে চলে যেতে হচ্ছে কেন, তাও পরিষ্কার বোঝা গেল না।
দুলাভাই আমাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিলেন। অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই বললেন, এখানের এক জন ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে আমার খুব জানাশোনা আছে। তোফাজ্জাল নাম। বেলুচ রেজিমেন্টের লোক। খুবই ভালো মানুষ।
আমি জানি, ইজাবুদ্দিন সাহেব বলেছেন।
দুলাভাই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, আর কী বলেছে ইজাবুদ্দিন?
নাহ, আর কিছু বলে নি।
দুলাভাই খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি এদের সঙ্গে মেলামেশা করি না। তোফাজলকে বাসায় পর্যন্ত আসতে বলি না। আমাকে প্রায়ই টেলিফোন করে। কয়েক দিন আগে রাজশাহীর এক ঝড়ি আম পাঠিয়েছে।
আমি চুপ করে রইলাম। দুলাভাই ক্লান্ত স্বরে বললেন, এদের সাথে বেশি। মাখামাখি করা ঠিক না। শীলার বন্ধু লুনাকে তো চেন? ঐ যে খুব সুন্দর দেখতে?
হ্যাঁ চিনেছি।
ওদের বাড়িতে খুব যাতায়ত ছিল মিলিটারিদের লুনার বাবা প্রায়ই পার্টিফার্টি দিতেন। এখন শুনলাম, এক মেজর নাকি লুনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ক্লাস নাইনে পড়ে মেয়ে, চিন্তা করে দেখ অবস্থাটা।
বিয়ে হচ্ছে?
দুলাভাই দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললেন, না হয়ে উপায় আছে? তবে আমি লুনার বাবাকে বলেছি সবাইকে নিয়ে সরে পড়তে। লোকটা ঘাবড়ে গেছে।
নীলুর সঙ্গে মতিনউদ্দিন সাহেবের বিয়ে সম্পর্কে যা শুনেছিলাম, তা বোধ হয় ঠিক নয়। বিলুকে এক দিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে কোধ ঝাঁকিয়ে বলেছে, দূর, কী যে বলেন। আপনিও কি মতিন ভাইয়ের মতো পাগলা নাকি?
বিলুর কথা অবশ্যি ধর্তব্য নয়। সে কখন কী বলে, তার ঠিক নেই। কখন সে রেগে আছে আর কখন শরিফ মেজাজে আছে, তাও বোঝা মুশকিল। এক দিন জিজ্ঞেস করলাম, বিলু, মতিন সাহেব শুনলাম আমেরিকা ফিরে যাবেন, সত্যি নাকি?
বিলুসঙ্গে সঙ্গে রেগে গেল। চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, যেতে চাইলে যাক, আমরা কি তাকে ধরে রেখেছি?
রাগ করছ কেন বিলু? আমি বিব্রত হয়ে বললাম।
রাগ করলাম কোথায়? রাগের কী দেখলেন? আমি কি আপনাকে বকেছি, না কিছু বলেছি?
বিলু মেয়েটিকে আমার বড়োই দুর্বোধ্য মনে হয়। পনের-ষোল বছরের একটি মেয়ের মধ্যে এতটা দুর্বোধ্যতার কারণ আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
এক দিন দুপুরবেলা আমাকে এসে বলল, শফিক ভাই, নীপা শব্দের অর্থ জানা আছে আপনার?
আমি অবাক হয়ে বললাম, না তো? কী জন্যে?
জানিবার জন্যে? এসো নীপবনে এসো ছায়াবীথি তলে। এই গানটি শোনেন নি আপনি?
শুনেছি।
ঐ জায়গায় তো নীপ শব্দটি আছে–এর মনে কী? নীলু আপা জানতে চেয়েছে?
জানি না। আমি। চলন্তিকা দেখে বলতে হবে।
কখন বলবেন?
আমার কাছে চলন্তিকা নেই। খুঁজে দেখতে হবে, রফিকের হয়তো আছে। তার ছোট ভাই বইপত্রের পোকা।
বেশ, তাহলে আজকে সন্ধ্যার আগে বলবেন, খুব জরুরী।
সন্ধ্যাবেলা নীপ শব্দের মানে জেনে ঘরে ফিরছি, গেটের কাছ দেখা নীলুর সঙ্গে। আমি বেশ উৎসাহের সঙ্গে বললাম, নীপ শব্দের মানে হচ্ছে কদম্ব। নীপবন হচ্ছে কদম্ববন।
নীলু মনে হল খুবই অবাক হল। আমি বললাম, বিলু বলছিল তুমি এর মানে মানে জানতে চাও?
নীলু ইতস্তত করে বলল, বিলু প্রায়ই আসে আপনার কাছে, তাই না?
তা আসে।
শফিক ভাই, ওকে আপনি প্রশ্রয় দেবেন না। বিলুর বয়স কম। এই বয়সে মেয়েরা অনেক মন-গড়া জিনিসকে সত্যি মনে করে।
আমি অবাক হয়ে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম নীলুর দিকে। নীলু হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, জলিল সাহেবের স্ত্রীকে কি আপনি খবর পাঠিয়েছেন?
না। তার ভাইকে চিঠি দিয়েছি।
উত্তর এসেছে কোনো?
না।
আসলে আমাকে জানাবেন।
সিগারেট আনতে
সকালে কাদেরকে সিগারেট আনতে পাঠিয়েছি, সে সিগারেট না নিয়ে ফিরে এল। তার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর।
ছোড ভাই, কাম সাফা! খেল খতম পয়সা হজম!!
সে খবর এনেছে, জেনারেল টিক্কা খানকে মেরে ফেলা হয়েছে। এত বড়ো খবরের পর সিগারেটের মতো নগণ্য জিনিসের কথা তার মনে নেই। দু দিন পরপর কাদের এই জাতীয় খবর নিয়ে আসে। এক বার খবর আনল বেলুচী এবং পাঞ্জাবী এই দুই দলের মধ্যে গণ্ডগোল লেগে ঢাকা কেন্টনমেন্টে দু দলই শেষ। একদম পরিষ্কার।
আরেক বার দরবেশ বাচ্চ ভাইয়ের দোকান থেকে পাকা খবর আনল, মেজর জিয়া চিটাগং এবং কুমিল্লা দখল করে ঢাকার দিকে রওনা হয়েছে। দাউদকান্দিতে তুমুল ফাইট হচ্ছে। রাত গভীর হলেই নাকি কামানের শব্দ শোনা যাবে।
বলাই বাহুল্য, টিক্কা খানের মৃত্যুসংবাদটিও বাঙ্গু ভাইয়ের তোকান থেকেই এসেছে। আমি প্রচণ্ড ধমক দিয়ে কাদেরকে দোকানে ফেরত পাঠালাম। সিগারেট ছাড়া আমি সকালের চা খেতে পারি না। কাদের ফিরল না। ঠিক দু ঘণ্টা অপেক্ষা করে নিচে নেমে দেখি আজিজ সাহেবের ঘরে মীটিং বসেছে; নেজাম সাহেব এবং মতিনউদ্দিন সাহেব দু জনেই মুখ লম্বা করে বসে আছেন। আজিজ সাহেব পায়ের শব্দ শুনেই আমাকে ডাকালেন, শফিক, কী সর্বনাশ! আজকে বেরুবে না। কোথায়ও। খবর শোন নি?