লোকটি কঠিন মুখে চুপ করে রইল।
ইজাবুদ্দিন সাহেব কিন্তু এমন ভাব করলেন, যেন আমি এক জন মহ? সম্মানিত ব্যক্তি। গাড়ি থামামাত্র ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নরম স্বরে বললেন, আসতে কোনো তোকলিফা হয় নাই তো?
না, কোনো তোকলিফা হয় নি। ব্যাপারটা কী?
আরে না ভাই, কিছু না। কথাবার্তা বলার জন্যে ডাকলাম। আসেন, ভেতরে গিয়ে বসি।
ভেতরে অনেক লোকজন বসে ছিল। এদের মধ্যে এক জনের মাথায় একটি ঝলমলে ঝুটিওয়ালা টুপি। লোকজন এখনো এই জাতীয় টুপি পরে, আমার জানা ছিল না। গাড়ির সেই শুকনো লোকটিকে দেখলাম আলাদা একটা টেবিলে। টেবিলে ফাইলপত্রও আছে। ইজাবুদ্দিন সাহেব বললেন, আপনার এইখানে এক জন লোক মারা গেছে শুনলাম। কীভাবে মারা গেল, কী সমাচার?
আমি বেশ স্পষ্ট স্বরেই বললাম, মিলিটারিরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
বলেন কী সাহেব!
ইজাবুদ্দিন সাহেব এমন ভাব করলেন, যেন অকল্পনীয় একটি ঘটনা শুনলেন। সেই শুকনো লোকটি সরু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তুর্কি টুপি-পরা ভদ্রলোক বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। তিনি এক সময় গলার স্বর উঁচু করে বললেন, লোকটি কে?
আমার এক জন ভাড়াটে। পরাহেজগার লোক। সাত বছর বয়স থেকে নামাজ কাজ করে নি।
ইজাবুদ্দিন সাহেব থেমে থেমে বললেন, বড়োই আফসোসের কথা। সিপাইদের হাতে দু-একটা এই রকম ঘটনা ঘটেছে। দশ জন মন্দের সাথে এক জন ভালোও শাস্তি পায়। দুনিয়ার নিয়মই এই। আমি ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে নিজে বলব ব্যাপারটা। ভবিষ্যতে এই রকম যেন না হয়।
আমি চুপ করে রইলাম। তুর্কি টুপি-পরা ভদ্রলোক বললেন, মৃত্যু স্বয়ং আল্লাহপাকের হাতে। আল্লাহপাক যদি ঐ লোকের মৃত্যু মিলিটারির হাতে লিখে থাকেন, তা হলে হবেই। আপনি আমি কিছুই করতে পারব না। কি বলেন ইজাবুদ্দিন সাহেব?
ইজাবুদ্দিন সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না।
আমি বললাম, আপনি কি এইটার জন্যেই ডেকেছেন?
জ্বি না, আমি ডেকেছি। অন্য ব্যাপারে। স্থানীয় কিছু গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে একটা শান্তিসভা হবে, যাতে মানুষের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়। সবারই এখন মিলেমিশে থাকা দরকার। আপনার বাবা ছিলেন এই অঞ্চলের এক জন বিশিষ্ট ভদ্রলোক! পাকিস্তান হাসেলের জন্যে তিনি যে কী করেছেন তা তো আপনি জানেন না, জানি আমি। জিন্নাহ সাহেবের সাথে তাঁর চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল। তাঁর ছেলে হিসাবে আপনার শান্তি সভাতে থাকা দরকার।
আমি থাকব।
তা তো থাকবেনই। না থাকলে কি আর আমি ডাকতাম আপনাকে? মানুষ চিনি তো। আপনার দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল সেদিন। তিনি আবার ব্রিগেডিয়ার তোফাজ্জল সাহেবের বিশিষ্ট বন্ধু। ইংল্যাণ্ডে উনার সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার সাহেবের পরিচয়। জানি তো সব, হা-হা-হা।
ইজাবুদ্দিন সাহেব আমাকে গাড়িতে করে ফেরত পাঠালেন! সেই শুকনো লোকটা এবারে। খাচ্ছে আমার সঙ্গে। তার ভাবভঙ্গি এখন আর আগের মতো নয়। খুব বিনীত অবস্থা। গাড়ি ছাড়ামাত্র বলল, কোনো রকম অসুবিধা হলে বলবেন আমাকে।
আপনাকে বলব কেন?
না, আমি মানে খোঁজখবর রাখি। অনেক রকম কানেকশন আছে, ইয়ে কি যেন বলে…
লোকটি থাতমত খেয়ে চুপ করে গেল।
বাসায় এসে দেখি বড়ো আপা চিঠি পাঠিয়েছে, তাতে লেখা–আগামী কাল দুপুরে আমরা নীলগঞ্জে চলে যাচ্ছি। তুমি অবশ্যই তোমার জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসবে। তোমার দুলাভাইয়ের ধারণা, অবস্থা খুব খারাপ।
আমি অবস্থা খারাপের তেমন কোনো লক্ষণ দেখলাম না। সব কিছুই বেশ স্বাভাবিক। মুক্তিবাহিনীটাহিনী বলে কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে। বড়ো আপার ধারণা, মুক্তিবাহিনীর সমস্ত ব্যাপারটাই আকাশবাণী কলকাতার দেবদুলাল বাবুর কল্পনায়। বড়ো আপাকে ঠিক দোষও দেওয়া যায় না, কলকাতার খবরগুলির প্রায় বার আনাই মিথ্যা। তাদের খবর অনুসারে যেদিন মুক্তিবাহিনীর বোমায় মগবাজার বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন কেন্দ্র সম্পূর্ণ বিকল বলা হল, তার পরদিনই বড়ো আপার বাসায় যাবার সময় দেখি সব ঠিকঠাক আছে। আরেক দিন বলা হল–মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমরের ফল হিসেবে ঢাকার রাজপথ আজ জনশূন্য। আমি দেখলাম দিব্যি লোকজন চলাচল করছে।
আমার জানামতে দু জন লোককেই পাওয়া গেল, যাদের স্বাধীন বাংলা বেতার এবং কলকাতা বেতারের খবরের উপর পূর্ণ আস্থা। এক জন আমাদের আজিজ সাহেব, অন্য জন কাদের মিয়া। কাদের মিয়া আবার যা শোনে, তার তিন গুণ বলে। রাতে শোবার আগে সে ইদানীং নিচু গলায় বলছে, ছোড ভাই, মিলিটারির পাতলা পায়খানা শুরু হইছে।
আমি এই জাতীয় আলোচনায় বিশেষ উৎসাহ দেখাই না, কিন্তু কাঁদেরের কোনো উৎসাহর প্রয়োজন হয় না।
বিবিসির খবর ছোড ভাই, চিটাগাং-এ পুরা ফাইট। ঢাকা শহরেও শুরু হইছে। খেইল জমতাছে ছোড়া ভাই।
কই, আমি তো কোনো খেইল দেখি না। ছোড ভাই, এইসব তো দেখনের জিনিস না। ভিতরের ব্যাপার। ইসকুরু টাইট হইতাছে, ছোড ভাই।
টাইট দেওয়া হলে তো ভালোই।
কাদেরের আগের ভাব এখন নেই। আগে সে বাড়িঘর ছেড়ে বড়ো আপার বাসায় গিয়ে ওঠার জন্যে ব্যস্ত ছিল, এখন সে-ব্যস্ততা নেই। তবে তার কাজ অনেক বেড়েছে। প্রতিদিনই এক বার মতিনউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে তার বৈঠক বসে। সেই বৈঠক রাত দশটা–এগারটা পর্যন্ত চলে। এক দিন দেখি–সে মতিনউদ্দিন সাহেবের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিচ্ছে। মতিনউদ্দিন সাহেব লাইটার এগিয়ে দিলেন। সকালবেলা নীলু। যখন খবরের কাগজ পড়ে তার বাবাকে শোনায়, কাদের মিয়া সেখানেও হাজির থাকে। এবং পড়া শেষ হলে গম্ভীর হয়ে বলে, একটাও সত্যি খবর নাই। এ ব্যাপারে। আজিজ সাহেবও তার সঙ্গে পুরোপুরি একমত।