মঙ্গলবার দুপুরে জলিল সাহেবের ভাই সবাইকে নিয়ে চাঁদপুর চলে গেলেন। একটি ঠিকানা দিয়ে গেলেন কোনো খবর থাকলে জানাবার জন্যে। ভদ্রলোক রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে থাকলেন। আমার কিছু একটা বলা উচিত। কোনো একটা আশার কথা। অর্থহীন কোনো সান্ত্বনার বাণী। কিছুই বলতে পারলাম না।
রাত্রে অনেক দিন পর কোনো কানা শোনা গেল না। তাদের তালা–দেওয়া বাড়ির সামনে একটা কুকুর এসে শুয়ে থাকল। রাত দশটাব দিকে দেখি সেই বাড়ির বারান্দায় বসে নেজাম সাহেব সিগারেট টানছেন। জলিল সাহেবের ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বেশ খাতির হয়েছিল। প্রায়ই দেখতাম দু জন একসঙ্গে বেরুচ্ছেন।
মতিনউদ্দিন সাহেব আজকাল খুব ঘনঘন আসেন। আজিজ সাহেবের ঘরে না। গিয়ে সরাসরি উঠে আসেন দোতলায়। আমার খোঁজ করেন না, চিকন সুরে কাদেরকে ডাকেন, ও কাদের মিয়া। কাদের আছে নাকি?
কাদের সাড়া দিলেই তিনি অসংকোচে বলেন, কাদের মিয়া, রাতে এখানে খাব।
বড়োই আশ্চর্য লাগে আমার কাছে। এক দিন বিকালে এসে দেখি, ভদ্রলোক
বলল, ইনার শইলডা খারাপ। গায়ে জ্বর।
কাদের, রাত্রে আমি ভাত খাব না। রুটি করবে।
আমাকে বললেন, জ্বর গায়ে ভাত খাওয়াটা ঠিক হবে না। কী বলেন শফিক ভাই?
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, আপনি কি এইখানেই থাকবেন নাকি?
ভদ্রলোক আমার চেয়েও আশ্চর্য হ য বললেন, জ্বরাজুরি নিয়ে যাব কোথায়? কাজের জন্যে যে ছেলে রেখেছিলাম, সেটাও চলে গেছে। একা–একা থাকি কী করে?
তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোক দুটি প্রকাণ্ড কালো রঙের সুটকেস সাথে করে নিয়ে এসেছেন।
বিলু ভদ্রলোকের কাণ্ড দেখে টেনে টেনে খুব হাসতে লাগল। আমার সামনেই নীলুকে বলল, আমি তোমাকে কত বার বলেছি, ভদ্রলোকের মাথা পুরোপুরি খারাপ। তুমি তো বিশ্বাস কর না।
নীলু খুবই রাগ করল। একেবারে কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। চোখ-মুখ লাল করে বলল, কী মনে করে ঘর-বাড়ি নিয়ে আপনি অন্যের বাড়িতে উঠে আসলেন?
একলা থাকতে পারি না নীলু। ভয় লাগে।
ভয় লাগে! আপনি কচি খোকা নাকি?
নীলু সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল। আমি অবস্থা সামলাবার জন্যে বললাম, এই সময় এক-একা থাকাটা ভয়েরই কথা।
নিচে থেকে নেজাম সাহেব হৈচৈ শুনে উঠে এসেছিলেন। তিনি মহা উৎসাহে বললেন, কোনো অসুবিধা নাই। আপনি ভাই আমার সঙ্গে থাকেন। ভূতের উপদ্রব এই বাড়িতে। এক-একা থাকতে আমারো ভয় লাগে।
মতিনউদ্দিন সাহেব পরদিন কাদেরকে নিয়ে বাড়ি থেকে সব জিনিসপত্র নিয়ে এলেন। মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে বিরাট এক একতলা বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। কাদেরের ভাষায় ঐ বাড়িতে একা–এক জ্বীনও থাকতে পারে না। আশেপাশে কোনো বাড়িতে কোনো লোক নেই। এই কদিন ভদ্রলোক কী করে এক-একা ছিলেন। তাই নাকি এক রহস্য।
কাদেরের কাছ থেকে আরো জানা গেল যে, মতিনউদ্দিন সাহেব এই দেশে থাকবেন না।–আবার চলে যাবেন। ভিসার জন্যে দরখাস্ত করেছেন। নতুন ব্যবস্থায় অজিজ সাহেব মহা খুশি। তাঁর মতে এটি একটি উত্তম ব্যবস্থা। সব দিক থেকেই ভালো। নীলুর মনোভাব ঠিক বোঝা যায় না। তাকে মতিনউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে গল্পটল্প করতে দেখি না, তবে এক দিন দেখলাম জামগাছের নিচে দু জনে কথা বলতে-বলতে হাঁটছে। আমাকে দেখতে পেয়ে নীলু চট করে আড়ালে সরে গেল। কী জন্যে কে জানে?
আজিজ সাহেব আজকাল আর আগের মতো আমাকে ডেকে পাঠান না। তাঁর ব্যস্ততা হঠাৎ করে খুব বেড়েছে। তিনি স্থির করেছেন ছৱিশে মার্চের পর থেকে কোথায় কী হচ্ছে সব লিখে রাখবেন। লেখার কাজটা করবে বিলু। তিনটি আলাদা খাতা করা হয়েছে। একটিতে লেখা হচ্ছে পাকিস্তান রেডিওর খবর, অন্যটিতে আকাশবাণী কলকাতার। তৃতীয়টি হচ্ছে স্বাধীন বাংলা, বি বি সি এবং ভয়েস অব আমেরিকার জন্যে।
জুন মাসে ঢাকার অবস্থা অনেক ভালো হয়ে গেল। কার্ফু সময়সীমা কমিয়ে রাত কারটা থেকে সকাল ছটা করা হল। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় যে-সব মিলিটারি চেকপোস্ট ছিল, সেখান থেকে মিলিটারি সরিয়ে পুলিশ বসান হল। ঢাকার সমস্ত পুলিশ মিলিটারির সঙ্গে যুদ্ধে মারা গেছে বলে যে-খবর পেয়েছিলাম সেটি বোধ হয় পুরোপুরি সত্যি নয়। চারদিকে প্রচুর পুলিশ দেখা যেতে লাগল।
সেন্ট্রাল শান্তি কমিটি থেকে বলা হল, সমগ্র দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এক জন ফরাসী সাংবাদিক পত্রিকায় বিবৃতি দিলেন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার সাবিক উন্নতি হয়েছে। তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা তার চোখে পড়ে নি। জনগণের মধ্যে আস্থার ভাব পুরোপুরি ফিরে এসেছে।
নীলক্ষেতের রাস্তা দিয়ে আসবার সময় দেখি মহসিন হলের অনেকগুলি জানালা খোলা। ছেলেরা দড়িতে শার্ট শুকতে দিয়েছে। সত্যি সত্যি হল খুলে দেয়া হয়েছে নাকি? হতেও পারে। পত্রিকায় দেখলাম আসন্ন রমজান উপলক্ষে রেশনে ঘি এবং সুজি দেওয়া হবে।
ঠিক এই সময় রফিকের ছোট ভাইটির বিয়ে হয়ে গেল। হঠাৎ করেই নাকি সব ঠিক হয়েছে। দুপুরবেলায় বিয়ে! আমাকে বরযাত্রী যেতে হল। রফিককে মনে হল বেশ সংকুচিত। তাকে বাদ দিয়ে ছোট ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এই কারণেই কিনা কে জানে।
বিয়েবাড়িতে গিয়ে দেখি হুলস্থূল কারবার। গেটের সামনে ব্যাও পাটি। ছোটছোট মেয়েরা পরীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড়ো ভালো লাগল দেখে। গেট-ধরনীরা হাজার টাকার কমে গোট ছাড়বে না। শুধু টাকা দিলেই হবে না। তিনটি ধাঁধা আছে, ভেতরে ঢুকতে হলে সেগুলিও ভাঙতে হবে। একটি ধাঁধা হচ্ছে, কাটলে কোন জিনিস বড়ো হয়। বরযাত্রী যারা ছিলাম, কারের বুদ্ধিসুদ্ধি বোধহয় সে-রকম নয়। আমরা কেউই একটি ধাঁধারও উত্তর দিতে পারলাম না। বাচ্চা মেয়েগুলি খুব হাসোহাসি করতে লাগল। হাসোহাসি করলে কী হবে, সবগুলি বিছু–গেট খুলবে না। শেষ পর্যন্ত মেয়ের বাবা এসে ধমক দিলেন, গেট খোল। সব সময় ফাজলামি।