আমজাদ আলি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, হিসাব কে রাখবে?
আপনি বলবেন কত বার হয়েছে আমি লিখে রাখব।
সেটা ঠিক হবে না। স্যার যদি দেখেন বারান্দায় আমি একা, তাহলে ভাববেন কোনো দুই নম্বরি হচ্ছে। খাতা-কলম নিয়ে কাউকে আমার সঙ্গে দিন।
ঠিক বলেছেন। আমি ব্যবস্থা করছি।
আমজাদ আলি উঠবোস শুরু করেছেন। প্রথম দিকে পায়ে টনটন ব্যথা হচ্ছিল। এখন ব্যথা নেই। তবে হাতের কনুই কেন জানি ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে দুই হাতেই কেউ দশ কেজি ওজনের দুটো পাথর ঝুলিয়ে দিয়েছে। বুকে এক ধরনের চাপ বোধ করছেন। এটা হাতের ব্যথার কাছে কিছু না।
সোবাহান সাহেবের ধমকে কাজ হয়েছে। আজ আর তাকে ঘিরে লোকজন দাঁড়িয়ে নেই। খাতা-কলম নিয়ে বাজার সর্দার কুদ্দুস বসে আছে। কুদ্দুস মনে হচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না। তিনি বললেন, কুদ্দুস ভালো আছ?
কুদ্দুস মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, জি স্যার।
বুড়ো বয়সে ভালো বিপদে পড়েছি, তাই না কুদ্দুস?
জি সার।
রোজ হাশরেও আমাদের সবার শাস্তি হবে। আল্লাহপাক স্বয়ং শাস্তি দিবেন। তবে সেই শান্তিতে লজ্জা নাই। কারণ সেই শান্তি অন্য কেউ দেখবে না। বেহেশতাসী একজন আরেকজনকে চিনবে কিন্তু দোজখবাসী কেউ কাউকে চিনবে না।
স্যার কি একটু বিশ্রাম নেবেন?
নাহ।
তাহলে পানি খেয়ে নেন।
আচ্ছা পানি নিয়ে আসো। পানি খাই। বুক শুকায়ে আসছে।
মবিনুর রহমান বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন।
এই বাড়ির বারান্দা পুরনো আমলের বারান্দার মতো। পনেরো হাত পাশের বিশাল বারান্দা। তার চেয়ারটা দেয়াল ঘেঁষে। চেয়ারের সামনে বেতের টেবিল। তার পরেও সাত-আট হতি জায়গা আছে। ঢাকা শহরে যে বাড়ি সেই বাড়ির জন্যে এত বড় বারান্দার কোনোই প্রয়োজন নেই। বারান্দা থেকে দেখার কিছু নেই। দালান, দালান এবং দালান। সাদা দেয়ালের দালাল, হলুদ দেয়ালের দালান, ইটের দালান।
তৰে মবিনুর রহমানকে দালান দেখতে হয় না। দুটা কাঁঠাল গাছ, একটা আমগাছ এবং একটা কামরাঙ্গা গাছ তাঁর বারান্দা শহর থেকে আলাদা করে রেখেছে। বারান্দায় বসলে মনেই হয় না সামনেই দালানের সমুদ্র। বরং মনে হয় তিনি শহরের বাইরে কোথাও আছেন। সে রকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ কাঠাল গাছে দুটা পাখি বাসা বেঁধেছে। হলুদ রঙের পাখি যার লেজটা লম্বা। বড় বড় শহরের গায়ে হলুদ পাখি বাসা বাঁধে না! কাক বাসা বাঁধে।
সকাল এগারোটা। মবিনুর রহমানের সামনের টেবিলে দুটা বাংলা এবং একটা ইংরেজি পত্রিকা রাখা আছে। পত্রিকার পাশে মগ ভর্তি কফি। তিনি এখনো পত্রিকার ভাঁজ খোলেননি, কফিতেও চুমুক দেননি। সব দিন তাঁর পত্রিকা পড়তে ইচ্ছা করে না। যেদিন পত্রিকা পড়েন না সেদিন কফিতেও চুমুক দেন না। মানুষের সব কাজই একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত।
আজ তাঁর মন বেশ খারাপ। গতকাল দুপুরে মুরগির মাংসের ঝোলের সঙ্গে কি খেয়েছেন তা মনে করতে পেরেছিলেন। রাত বারটার দিকে মনে পড়েছিল এখন আর মনে পড়ছে না। বাবুর্চিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেই হয়, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না। তিনি ঠিক করেছেন আজ সারাদিনই মনে করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। তবে মনের উপর বেশি চাপ দেবেন না।
মবিনুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ডাকলেন, বাবুল আসো এদিকে।
শফিক পাশের ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
মবিনুর রহমান টেবিলে পা তুলতে তুলতে বললেন, কয়টা বাজে বলো তো?
স্যার এগারোটা বাজে।
কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা না দুএক মিনিট এদিক-ওদিক আছে?
এগারোটা তিন।
তোমার এখান থেকে অফিস ঘরের বারান্দা দেখা যায়?
জি স্যার যায়।
আমজাদ কি এখনো উঠবোস করছে?
জি না।
তুমি একটা চেয়ার টেনে পাশে বসো।
শফিক চেয়ার টেনে পাশে বসল। তার অস্বস্তি লাগছে। বসের মুখোমুখি বসা যায়। পাশাপাশি কেন জানি বসা যায় না। মবিনুর রহমান বললেন, বাবুল, তোমার কি কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে? নাকি তুমি টি ড্রিংকার?
মাঝে মধ্যে কফি খাই।
তাহলে কফিটা খাও। আমি মুখে দেইনি।
এখন ইচ্ছে করছে না স্যার।
ইচ্ছা না করলে খেতে হবে না। আমি আমার নিজের ইচ্ছা অন্যের ওপর চাপাতে খুবই অপছন্দ করি, কেন অপছন্দ করি বলো তো?
বলতে পারছি না স্যার।
আমার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে অন্যের ইচ্ছায়। তিতা করলা আমার খুবই অপছন্দের একটা খাবার। আমার শৈশব কেটেছে তিতা করলা খেয়ে। করলার সিজনে বাবুপুরা এতিমখানায় তিতা করলা হবে না— এটা হতেই পারে না। বাবুল এখন কি করলার সিজন?
জি স্যার।
তাহলে তো একবার করলা ভাজি করতে বলতে হয়। তুমি কি করলা ভাজি পছন্দ করো?
জি করি।
ভেরি গুড, তাহলে আগামীকাল করলা ভাজি হবে। তুমি খাবে। আমি খাব। আমি শুধু দেখব। ঠিক আছে বাবুল?
জি স্যার।
লক্ষ্য করেছ তোমার নাম আমার মনে আছে? ছড়াটা কাজে লেগেছে। তোমার মেয়ের নামও আমার মনে আছে। তোমার মেয়ের নাম নিশো। হয়েছে?
জি স্যার।
নিশো কি করলা ভাজি খায়?
বলতে পারছি না। আমি মনে করতে পারছি না।
তোমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও। তোমার স্ত্রীর নাম কী?
মীরা।
তোমার স্ত্রীর নাম; কিন্তু আমার মনে থাকবে না কারণ তার নাম নিয়ে আমি ছড়া বানাইনি। তোমার স্ত্রীর প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ল— আমি বিয়েও করেছিলাম অন্যের ইচ্ছায়। নিজের ইচ্ছায় না। খুবই ইন্টারেস্টিং গল্প। তোমাকে একদিন বলব। শুনলে মজা পাবে। তুমি চাইলে আজও বলতে পারি। বলব?