শফিক পান মুখে দিল। মীরা বলল, আমি কি মঞ্জু মামার আনা লিচুর কয়েকটা খেতে পারি? না-কি তাও খাওয়া যাবে না! অনুমতি দিলে খেতে পারি।
খাও।
আরেকটা কথা, আজ রাতে তোমার কি আর কিছু লাগবে? লাগলে এখনি বলো। বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। তারপর ডেকে তুলবে, এর চেয়ে আগেই ফয়সালা হয়ে যাওয়া ভালো। লাগবে কিছু?
হুঁ।
সাজতে হবে? না-কি যেমন আছি তেমন থাকলেই হবে? তোমার মধ্যে এই এক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম— বিশেষ প্রয়োজনের আগে সাজতে হবে। বাতি তো থাকে নেভানো। তুমি তো আর সাজটা দেখছ না।
সব মানুষ তো এক রকম না। একজন মানুষ একেক রকম।
তা ঠিক।
শফিক দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরতে ধরাতে বলল, তোমার কথাবার্তায় গণ্ডগোল আছে। তুমি কী করে বললে, তোমার মধ্যে এই এক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। তুমি তো একমাত্র আমাকেই দেখেছ। অন্য কারো সঙ্গে নিশ্চয়ই বিছানায় যাওনি।
আমি একটা কথার কথা বলেছি।
এরকম কথা কথা দয়া করে আমাকে বলবে না। তোমার মঞ্জু মামাকে বলতে পারো। আমাকে না।
মঞ্জু মামার কথা এখানে এলো কী জন্যে?
আমি এনেছি তাই এসেছে।
মীরা ঘরের কাজ শেষ করে সাজতে বসল। সিল্কের শাড়ি পরল। ঠোঁটে লিপস্টিক দিল। চোখে কাজল দিল। সে আয়নায় নিজেকে দেখছে। কী সুন্দর মায়া মায়া একটা মুখ! এ রকম মায়া মায়া চেহারার একজন তরুণীর সঙ্গে তার স্বামী খারাপ ব্যবহার কী করে করে তা মীরা বুঝতে পারছে না। তার মন খারাপ লাগছে।
শফিক খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। নিশো তার গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে ঘুমুচ্ছে। তবে তার ঘুমের ব্যাপারে কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায় না। এই মেয়ে মাঝে মাঝে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। খুব অস্বস্তিকর সময়ে হঠাৎ উঠে বসে হতভম্ব গলায় বলে, বাবা তোমরা এসব কী করছ? তাদের একটা শোবার ঘর।
দুটা ঘর থাকলে ভাল হতো। একটা ঘরে থাকতে নিশো। নিশো তখন একা ঘুমাতো না। নিশোর সঙ্গে থাকতেন তার দাদু।
চাকরিটা যদি সত্যি সত্যি পার্মানেন্ট হয়ে যায়, তাহলে সে অবশ্যই দুই শোবার ঘরওয়ালা একটা বাসা ভাড়া করবে। বাবা-মা দুজনকেই এনে সঙ্গে রাখবে।
চায়ের কাপ হাতে মীরা ঘরে ঢুকেই বলল, তোমার মেয়ে কী ঘুমুচ্ছে?
শফিক বলল, হ্যাঁ।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে না। চোখ পিটপিট করছে।
শফিক কিছু বলল না, চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, চা-টা ভালো হয়েছে।
মীরা বলল, আমার সাজ কী তোমার পছন্দ হয়েছে?
হুঁ।
প্রথম যেদিন বেতন পাবে আমাকে সাজের কিছু জিনিস কিনে দিও। আমি আরো সুন্দর করে সাজব।
আচ্ছা দেব।
বাসাটা বদলাবে না?
বদলাবো। বাবা-মাকে সঙ্গে এনে রাখব।
আমি কি বাসা খোঁজা শুরু করব?
তুমি কোথায় খুঁজবে?
নিশোকে স্কুলে দিয়ে আমরা সব গার্জেনরা বাইরে বসে গল্প-গুজব করি। তাদের মাধ্যমে অনেক খবর পাওয়া যায়। তুমি যদি বলো আমি কাল থেকেই বাসা খোজা শুরু করব।
তাড়াহুড়া করার কিছু নেই। চাকরি টিকবে কিনা এখনো জানি না। বুড়ো বলল, সে আমাকে পরীক্ষা করে দেখছে। পরীক্ষায় পাস করতে পারলেই চাকরি টিকবে।
কী পরীক্ষা?
জানি না কি পরীক্ষা। মুমুতে আস, বাতি নেভাও।
মীরা সুইচ বোর্ডে হাত দেবার আগেই নিশো বলল, মা এখন নেভাবে না। আমি ঘুমাইনি।
সকাল আটটা বাজে
সকাল আটটা বাজে।
আমজাদ আলি আতর-বাড়ির অফিস ঘরে চায়ের কাপ হাতে বসে আছেন। চা বিস্বাদ লাগছে। একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। সিগারেটে টান দিতেই মাথায় চক্কর দিল। বমি বমি ভাব হলো। সবই শরীর খারাপের লক্ষণ। রাতে ভালো জ্বর এসেছিল। পা ফুলে ঢোল। তিনি তার ছোট মেয়ে শায়লাকে পায়ে তেল মালিশ করতে বলেছিলেন। শায়লা তেল মালিশ করতে এসে বিস্মিত হয়ে বলল, তোমার পায়ে কি পানি এসেছে নাকি? তিনি কিছু বললেন না, যদিও মেয়ের কাছে সত্যি কথাটা বলার ইচ্ছা একবার হয়েছিল। মেয়ে কথা রাখতে পারবে না। সবাইকে বলে বেড়াবে এই ভয়ে বলেননি।
তিনি কানে ধরে উঠবোস করছেন— এই ঘটনা অবশ্যই চাপা থাকা দরকার। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে বড় দুটার বিয়ে হয়েছে। ওদের কাছে খবর পৌঁছে গেলে বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে দুটা অপমানিত হবে। সবচে বড় সমস্যা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে। এই মহিলার মাথায় সামান্য গোলমাল আছে। রাগারাগি করে ঘুমের ওষুধ খাওয়া, সিলিং ফ্যানে শাড়ি ঝুলানো প্রায়ই করে। কানে ধরে উঠবোসের কথা শুনলে বিরাট কোন কেলেঙ্কারি অবশ্যই করবে।
আমজাদ ভাইয়ের শরীর খারাপ নাকি?
ক্যাশিয়ার সোবাহান সাহেব কখন ঘরে ঢুকেছেন, কখন তার চেয়ারে বসেছেন আমজাদ আলি তা মনে করতে পারলেন না। মনে হয় চায়ের কাপ হাতে নিয়েই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি সোবাহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটু মনে হয় খারাপ। রাতে ঘুম হয় নাই। ভাবছি আজ উঠবোসটা করব না। রেস্ট নেব।
সোবাহান সাহেব বললেন, কিছুক্ষণের জন্যে করুন। স্যার আজ বারান্দায় বসেছেন। বারান্দা থেকে দেখবেন যে উঠবোস চলছে। স্যারের নজরে আসা দরকার না?
অবশাই দরকার।
সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে করেন। কোনো টাইম লিমিট তো নাই।
তা ঠিক।
আমি সবাইকে কঠিনভাবে বলে দিয়েছি কেউ ভিড় করবে না। আর আপনার এত লজ্জা পাওয়ারও কিছু নাই। আগে পেটে ভাত তারপর লজ্জা কী বলেন ঠিক বলছি না?
জি।
আমার ধারণা আরো কয়েক দিন পার হলে স্যার নিজ থেকেই বলবেন—আর লাগবে না। অপরাধ মাপ। সেই সম্ভাবনা আছে না?
আছে।
তাহলে দেরি না করে শুরু করে দিন। স্যার আবার ঘরে চলে যেতে পারেন। চা শেষ করে যান।