জানি না কাজ কি।
আজ সারাদিন কী করলে?
কিছুই করিনি। দোতলার বারান্দায় বসেছিলাম। মাঝে মধ্যে ডেকে জিজ্ঞেস করে, কয়টা বাজে? আরে ইঁদুর তোর হাতে ঘড়ি আছে না? তুই ঘড়িতে দেখ কয়টা বাজে।
একজন বয়স্ক মানুষ, তুই-তোকারি করছ কেন?
মাথারও মনে হয় ঠিক নাই। উল্টাপাল্টা কথা—আমার নাম মনে থাকে না এই জন্যে নাম দিয়ে ছড়া বানিয়েছে।
কী ছড়া?
বাবুল, হাবুল, কাবুল।
মীরা হাসতে হাসতে বলল, বানিয়ে বানিয়ে এইসব কী বলছ?
একটা কথাও বানানো না। বাবুল হাবুল কাবুল। ছড়াকার এসেছে?
মীরা হাসছে। হাসি বন্ধ করার চেষ্টা করছে। পারছে না। শফিক স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মুগ্ধ হয়ে গেল। মীরাকে মাঝে মাঝে খুবই সুন্দর লাগে। আজ লাগছে। আপন মনে হাসছে বলেই কি সুন্দর লাগছে? শফিক বলল, বুড়োর মুখটা ছোট কিন্তু বিশাল এক গোঁফ রেখে বসে আছে। মেথরদের মতো গোফ।
মীরা বলল, ওনার এত সমালোচনা করার দরকার নেই, তুমি উঠে পড়ো। ঠাণ্ডা লাগবে।
গায়ে সাবান দেব। সাবান এনে দাও। ঘরে সাবান আছে না?
আছে।
মীরা সাবান এনে দিল। বাবুলের সাবান মাখা হলো না। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। পানির ধারা স্রোত নেই। এখন টিপটিপ করে পানি পড়ছে। মীরা বলল, সাবান মাখতে চাইলে মাখ, বালতিতে পানি আছে তো?
শফিক বলল, পানি নষ্ট করব না। থাক।
মীরা বলল, তোমার বেতন কত ঠিক হয়েছে?
বেতন খারাপ না।
খারাপ নাটা কত বলল শুনি।
টুয়েলভ।
টুয়েলভ মানে কি বার হাজার? সত্যি?
ক্যাশিয়ার তো তাই বলল। আবার একটা মোবাইল টেলিফোনও নাকি দেবে। যাতে মোবাইলে যোগাযোগ থাকে। আমার লাইফ হেল করার বুদ্ধি। রাত তিনটার সময় টেলিফোন করে বলবে, বাবুল হাবুল কাবুল– কয়টা বাজে?
তুমি দেখি ওনাকে একেবারেই পছন্দ করছ না।
পছন্দটা করব কেন? আমার ইংরেজি সাহিত্যে একটা এমএ ডিগ্রি আছে। আমার চাকরিটা কী? একটা পয়সাওয়ালা ইঁদুরের প্রতিটি কথায় ইয়েস স্যার বলা। এই চাকরি তো আমি অবশ্যই করব না। চাকরি মানে তো শুধু টাকা না। এক ধরনের ফুলফিলমেন্ট থাকতে হবে। পারপাস থাকতে হবে। জব স্যাটিসফেকশন থাকতে হবে।
এ রকম চাকরি তো অনেক দিন ধরেই খুঁজলে, কিছু তো পাওনি।
তার মানে তো এই না যে কোনো দিনও পাব না।
যেদিন পাবে সেদিন এই চাকরি ছেড়ে দেবে।
অবশ্যই ছেড়ে দেব এবং ইঁদুরটার গায়ে এক বোতল পানি ঢেলে চলে আসব। আমি ঠাট্টা করছি না। ঐ কার্টুনের গায়ে আমি সত্যি পানি ঢালব।
মীরা বলল, কেন শুধু শুধু গালাগালি করছ। ঐ প্রসঙ্গটা বাদ দাও না।
শফিক বলল, তোমার রান্না সারতে মনে হয় দেরি হবে। আমাকে এক কাপ চা দিও। শরীর ঠাণ্ডা মেরে গেছে। চা-টা যেন কড়া হয়। তুমি পাতলা চা বানাও, খেতে ভাল লাগে না।
মীরা বলল, এখন চা খাওয়ার দরকার নেই। ক্ষিদে নষ্ট হবে। তুমি ঘড়ি ধরে বসে থাকো, আমি ঠিক কুড়ি মিনিটের মাথায় খাবার দেব।
শফিক বলল, চা দিতে বলেছি চা দাও। আমার ক্ষিদা নষ্ট হবে কি হবে না এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
মীরা বলল, মেজাজ খারাপ কেন?
শফিক বলল, মেজাজ ঠিক আছে। তুমিও দেখি বুড়োর মতো বেশি বেশি কথা বলছ। এত কথা বললে রান্নাটা করবে কখন?
শফিক খুবই তৃপ্তি করে খাচ্ছে। এত দ্রুত খাচ্ছে যে মীরার ভয় ভয় করছে। ভাত কম পড়ে যাবে না তো? এখন সে যদি বলে, আরেক চামচ ভাত দাও— ঝোল দিয়ে খাব। তাহলে মীরা ভালো বিপদে পড়বে। হাঁড়িতে কোনো ভাত নেই। তার নিজের প্রেষ্টে আছে। শফিক যে মানুষ মীরা যদি নিজের প্লেট থেকে ভাত তুলে দেয় সে খাবে না।
মীরা বলল, মাছটা ফ্রেশ ছিল।
শফিক বলল, রান্না খুব ভাল হয়েছে। তুমি একদিন আমাকে ইলিশ মাছ রান্না শিখিয়ে দিও।
তুমি রান্না শিখে কী করবে?
বুড়ো যে কোনো একদিন বলে বসতে পারে— বাবুল হাবুল কাবুল ইলিশ মাহু রান্না করো।
উনি খামখা তোমাকে ইলিশ মাছ রান্না করতে বলবেন কেন? তুমি দেখি ভদ্রলোককে মাথা থেকে দূরই করতে পারছ না। ওনাকে মাথা থেকে অফ করো তো।
শফিক বলল, আচ্ছা যাও অফ করলাম। নিশো খেয়েছে?
এক গাদা লিচু খেয়েছে। পেটে ক্ষিদা নেই।
লিচু? লিচু এলো কোত্থেকে?
মঞ্জু মামা এনেছিলেন। রাজশাহীর লিচু। তুমি খাবে? এনে দেই?
না।
খাও না। খুব মিষ্টি। পোকা নেই। তুমি তো এই সিজনে লিচু খাওনি।
বললাম তো খাব না।
তুমি না খেলে নাই। আমি খাব। এই শোনো আমি আর পাতের ভাত খেতে পারছি না ভাত নষ্ট হবে। তোমার প্লেটে তুলে দেই?
শফিক কথা না বলে প্লেটেই হাত ধুয়ে ফেলল। বোঝাই যাচ্ছে সে খুব রেগেছে। রাগের কারণ মীরা খানিকটা ধরতে পারছে।
মীরা বলল, পান খাবে? পান দেই?
পান কোথায় পেয়েছ?
মঞ্জু মামা পান খেতে চাইলেন। দোকান থেকে কয়েক খিলি পান আনাতে বললেন। তোমার জন্যে দুই খিলি রেখে দিয়েছি। তুমি তো মাঝে মধ্যে পান খাও।
শফিক সিগারেট ধরাল। সে কঠিন চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা বলল, এ রকম করে তাকিয়ে আছ কেন?
শফিক বলল, তুমি খাওয়া শেষ করো, তোমাকে একটা কথা বলব।
আমার খাওয়া শেষ। কি বলতে চাও বলো।
শফিক থমথমে গলায় বলল, তোমাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি, মঞ্জু নামের এই লোকটি যেন বাসায় না আসে।
ওনাকে আমি মামা ডাকি।
মামা, আংকেল এইসব আমাকে শিখাবে না।
মীরা বলল, উনি যদি বেড়াতে আর্সেন আমি কী বলব? বলব বাসা থেকে বের হয়ে যান?
হ্যাঁ বলবে।
মীরা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অতি তুচ্ছ জিনিসকে বড় করার তোমার অস্বাভাবিক এক ক্ষমতা আছে। তুমি লেখক হলে ভালো হতো। তিলকে তাল করতে পারতে। মুখ ভেঁতা করে রাখবে না। পান খাও।