কে একজন দূর থেকে তাকে দেখছে। সাদা প্যান্ট সাদা শার্ট। মাথায় সাদা ক্যাপ। বাবুর্চি নাকি? ইংরেজি কায়দায় শেফ। শেফের পোশাক না পরে রাঁধতে পারে না এমন কেউ? তার এপ্রনের পকেটে কি থার্মোমিটার আছে? ডেগচিতে থার্মোমিটার দিয়ে টেম্পারেচার দেখে নিল। খাতায় নোট রাখল— বড় সাহেবের জন্যে ইলিশ মাছের ঝোল রান্না করা হয়েছে এই তাপমাত্রায়। বাবুর্চির সঙ্গে কথা বলা দরকার। তার সঙ্গেই ডাল রাঁধতে হবে। রান্না কি এই ফাঁকে সেরে নেবে? বাবুর্চির অবসর কখন সেটাও দেখতে হবে। বাবুর্চি যদি বলে বসে— এই পোশাকে তো রান্নাঘরে ঢুকতে পারবেন না। প্রপার ড্রেস লাগবে।
শফিকুল এগিয়ে গেল। বাবুর্চি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। বাবুর্চি শ্রেণী সব সময় রান্নার হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে বলে মানুষের দিকে চোখ তুলে কম তাকায়। একদৃষ্টিতে তাকায় শুধু শিক্ষক শ্ৰেণী।
স্যার স্নামালিকুম। আমার নাম গনি। আব্দুল গনি।
শফিকুল করিম বলল, কেমন আছ গনি?
স্যার ভালো আছেন? অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে আছেন।
বারান্দাতেই আমার বসে থাকার কথা।
টিভি রুম সেখানে বসতে পারেন। লাইব্রেরি রুম আছে, সেখানেও বসতে পারেন। চা-নাস্তা কিছু লাগলে আমাকে বলবেন।
থ্যাংক ইউ।
গনি নামের বাবুর্চিকে ভালো লাগছে। নম্র ভঙ্গিতে কথা বলছে, বাড়ি মনে হয় যশোরের দিকে। ভাষা শুদ্ধ।
আব্দুল গনি।
জি স্যার।
বড় সাহেব আমাকে ডাল রান্না করতে বলেছেন। উনি রেসিপি দিয়ে দিয়েছেন।
আপনাকে কিছুই রান্না করতে হবে না। বড় স্যার কোনো কিছু মনে রাখতে পারেন না। আপনাকে একটা কথা বলে পাঁচ মিনিট পরেই ভুলে যাবেন।
তাই নাকি?
জি।
এত বড় বাড়িতে উনি একা থাকেন?
উনার সঙ্গে আমরা আছি। উনি একা। এতিমখানায় বড় হয়েছেন। বাবা-মা কে তাও জানেন না। টাকার পাহাড়ের ওপর বসে আছেন। খরচ কে করবে তার নাই ঠিক। চা বানিয়ে দেই খান?
দাও।
আপনার মনে হয় সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। লাইব্রেরি ঘরে বসে খান। স্যার লাইব্রেরি ঘরে কখনো আসেন না। উনি দিন-রাত নিজের ঘরেই থাকেন, মাঝে মধ্যে বারান্দায় এসে বসেন।
তুমি সাহেবের সঙ্গে কত দিন আছি?
প্রায় দশ বছর।
উনি মানুষ কেমন?
বড় মানুষদের যেসব আজেবাজে সমস্যা থাকে, তার এসব কিছুই নাই। অন্তত আমি দেখি নাই। মদ না, মেয়ে মানুষ না। ভালো-মন্দ খেতেও পছন্দ করেন না। খামখাই টাকা রোজগার করলেন। আপনাকে মনে হয় স্যার ডাকছেন। শুনে আসুন।
শফিকুল করিম অবাক হয়ে বলল, আমাকে কখন ডাকলেন? আমি তো কিছু শুনিনি।
আমি শুনেছি। আমার কান পরিষ্কার।
দরজা ঠেলে বড় সাহেবের ঘরে ঢুকল। বুড়ো এখনো আগের জায়গাতেই আছে। টিভি চলছে। তবে বুড়োর চোখ বন্ধ।
বাবুল।
জি স্যার?
কয়টা বাজে?
সাড়ে এগারোটা।
তার মানে তুমি প্রায় এক ঘণ্টা বারান্দায় বসেছিলে?
জি স্যার।
একজন যে কানে ধরে উঠবোস করছে এই দৃশ্য কি বারান্দা থেকে দেখা যায়?
স্যার আমি লক্ষ্য করিনি।
দেখা যাওয়ার কথা। এরা ঘটনাটা এমন জায়গায় করবে যেন আমি দোতলা থেকে দেখতে পারি।
শফিকুল করিম কিছু বলল না। কী বলবে সে? কী বললে বুড়ো খুশি হবে? চাকরি বজায় রাখতে হলে বুড়োকে খুশি রাখতে হবে। মাসে বার হাজার টাকা বিরাট ব্যাপার। কিস্তিতে সে ফ্রিজ কিনতে পারে। ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি নিশোর খুবই শখের ব্যাপার। তার চেয়েও বড় ব্যাপার বুড়ো বাবাকে সঙ্গে এনে রাখা। যে বাবা তাকে বাবুল নামে ডাকেন। মাঝে মাঝে শুধুই বাবু। ল বাদ পড়ে যায়। বাবা তাকে যে নামে ডাকেন, এই কার্টুন বুড়ো তাকে সেই নামে ডাকছে। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে! কার্টুনটাকে এই নাম বলা ঠিক হয়নি। বললেই হতো তার নাম শামসু বা ফজলু।
বাবুল!
জি স্যার।
দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোসো, তোমার সঙ্গে কথা বলি।
এই ঘরে দ্বিতীয় কোনো চেয়ার নেই। বসতে হলে মেঝেতে বসতে হবে। এটা বোধহয় নিয়ম। বড় সাহেব সিংহাসনে বসে থাকবেন। সভাসদরা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসবে।
পঞ্চাশ হাজার বার কানে ধরে উঠবোসের শাস্তিটা তোমার কাছে কেমন লাগছে?
অন্য রকম লাগছে স্যার।
শাস্তির এই পদ্ধতি আমি শিখেছি বাবুপুরা এতিমখানায়। এতিমখানার প্রিন্সিপাল ছিলেন মুনশি ইদরিস। তিনি সব সময় গায়ে আতর মাখতেন। আতরের নাম মেশকে আম্বর। আমিও মাঝে মাঝে মাখি। কেউ কোনো অপরাধ করলেই মুনশি ইদরিস তাকে পশ্চিম দিকে ফিরে কানে ধরে উঠবোস করতে বলতেন। শান্তির মাত্রার ওপর কানে ধরে উঠবোসের সংখ্যা নির্ভর করত। এতিমখানার বাবুর্চিকে তিনি পঞ্চাশ হাজার বার কানে ধরে উঠবসের শাস্তি দিয়েছিলেন। সে চেষ্টা করেছিল। সাত হাজার বার পর্যন্ত করেছিল। ইন্টারেস্টিং না?
জি স্যার।
বাবুর্চি কি অপরাধ করেছিল জানতে চাইলে না?
শফিকুল করিম চুপ করে রইল। তার মনে হচ্ছে সে একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছে। বাবুর্চি কী করেছিল জানতে চাওয়া প্রয়োজন ছিল। বুড়ো গল্প করতে চাইছে। তাকে গল্প চালিয়ে যেতে হলে শ্রোতার কাছ থেকে কিছু শুনতে হবে। তার কাজ কী? বুড়োর গল্প শোনা?
বাবুল।
জি স্যার।
ঠিক আছে তুমি বারান্দায় থাকে। প্রয়োজন হলে তোমাকে ডাকব।
জি আচ্ছা।
শুধু যদি ঝুম বৃষ্টি নামে আমাকে খবর দেবে। পিট পিট বৃষ্টি হলে খবর দিতে হবে না।
জি আচ্ছা।
তোমার ডিউটি সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। অসুবিধা আছে?