দশটা পঁচিশ।
এটা আমার একটা বদভ্যাস সময় জিজ্ঞেস করা। প্রায়ই সময় জিজ্ঞেস করব। তুমি বিরক্ত হয়ো না।
বিরক্ত হব না স্যার।
আকাশ খুব মেঘলা না?
জি স্যার।
ঠিক আছে, এখন যাও। বারান্দায় বসে থাকো। বৃষ্টি নামলে আমাকে খবর দিও। শোবার ঘর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে কি হচ্ছে না এটা বোঝা যায় না।
জি আচ্ছা স্যার।
তোমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রেসিপির মূল জায়গাটা মিস করেছি। টিভিতে পিজা রান্না শিখাচ্ছিল। তুমি রান্না-বান্না কিছু জানো?
না।
কোনো দিন রাঁধোনি? ভাত-ডাল-ডিম ভাজি?
জি না।
বলো কী! জীবনে কখনো রাঁধেনি এমন পুরুষ মানুষ পাওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার। ছোটখাটো রান্না আমি নিজেও পারি। ডালটা তো খুব ভালো পারি। ডাল রান্নার আসল কৌশল জানো?
না।
সিদ্ধ করা, আর কিছু না। যত সিদ্ধ করবে ভাল ততই ভালো হবে। নরমাল সিদ্ধের চেয়ে প্রেসার কুকারের সিদ্ধ ভালো হয়। সিদ্ধ হয়ে যাবার পরের অংশটার নাম বাগার। হাঁড়িতে কিছু তেল নেবে। সেখানে পেঁয়াজকুচি রসুন-কুচি দিয়ে দেবে। পেঁয়াজ এবং রসুনকুচি যখন ভাজা ভাজা হয়ে যাবে, তখন সিদ্ধ ডাল দিয়ে দেবে। পরিমাণ মতো লবণ দেবে। কাঁচামরিচের গন্ধের জন্যে ফালা-ফালা কয়েকটা কাঁচামরিচ দিতে পার। কেউ কেউ পাঁচফোড়ন দেয়। পাঁচফোড়ন দিলে ভালে হিন্দু হিন্দু গন্ধ হয়ে যায় বলে আমি দেই না। এখন মনে হচ্ছে না ডাল রান্নাটা খুব সহজ?
মনে হচ্ছে স্যার।
এক কাজ করো আগামীকাল তুমি ডাল রান্না করো। দেখি কেমন হয়। মানুষের সব ধরনের ট্রেনিং থাকতে হয়।
জি স্যার।
তোমার নাম বাবুল, তাই না?
জি।
এই দেখ তোমার নাম মনে আছে। তোমার নাম মনে রাখার জন্যে আমি সুন্দর একটা পদ্ধতি বের করেছি। এই পদ্ধতিকে বলে মেথড অব রাইম। মিল পদ্ধতি। মনে মনে তোমার নাম দিয়ে একটা ছড়া বানিয়ে কয়েকবার বলেছি। ছড়াটা মাথায় ঢুকে গেছে। ছড়াটা হচ্ছে—
বাবুল
হাবুল
কাবুল।
এই পদ্ধতিতে তুমি যে কোনো মানুষের নাম মনে রাখতে পারবে। তারিখ মনে রাখার জন্যেও একটা পদ্ধতি আছে। তোমাকে শিখিয়ে দেব। আমার কাছে একটা বইও আছে রিমেমবারিং নেমস অ্যান্ড ডেটস। পুরোটা পড়া হয়নি, কয়েক পাতা পড়েছিলাম। ইদানীং বই পড়ি না। আচ্ছা এখন যাও। অনেক কথা বলে ফেলেছি। বেশি কথা বলার অভ্যাস আগে ছিল না। ইদানীং হয়েছে। আমার বিছানার পাশে দেখ সিগারেটের প্যাকেট আছে, লাইটার আছে। আমাকে দিয়ে চলে যাও। আজ আর বৃষ্টিতে ভিজব না।
তুমি ম্যারিড?
জি স্যার।
বাচ্চা-কাচ্চা আছে?
একটা মেয়ে।
বয়স কত?
তিন বছর।
নাম কী?
নিশো।
নাম তো সুন্দর। নিশো। দাঁড়াও মনে রাখার ব্যবস্থা করি— নিশো, শিশু, যিশু। এই যে মাথায় নামটা ঢুকিয়ে দিলাম আর যাবে না। তোমার মেয়ের জন্যে আমার মাথার ভেতর একটা পার্মানেন্ট জায়গা হয়ে গেল।
শফিকুল করিম তাকিয়ে আছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। বুড়োকে কার্টুনের মতো লাগছে। কথাবার্তাও কার্টুনের মতো। এই কার্টুন বুড়ো কোটি কোটি টাকা বানিয়ে ফেলেছে— এটা বিশ্বাস করা কঠিন। বুড়োর গা দিয়ে আতরের গন্ধ বের হচ্ছে। আতর মেখেছে নাকি? বাড়ির নাম আতর বলেই গায়ে আতর মেখে বসে থাকতে হবে?
মবিনুর রহমান কিছুক্ষণ দুলুনি বন্ধ রেখেছিলেন। আবার শুরু করলেন। তিনি টিভির দিকে চোখ ফেরালেন। পিজা রান্না শেষ হয়ে গেছে। দর্শকরা পিজা খাচ্ছে। দর্শকদের খাওয়া দেখে তার নিজেরও ক্ষিদে লেগে গেল। অথচ কিছুক্ষণ আগেই তিনি দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিয়েছেন। আতপ চালের ভাত, মুরগির ঝোল মাংস, আরেকটা কি যেন আইটেম ছিল তার মনে পড়ছে না। মনে করার চেষ্টা করতে হবে। আজকাল কিছুই মনে থাকছে না। খুব খারাপ লক্ষণ। বিস্মৃতি রোগ। ডাল কি ছিল? অবশ্যই ছিল। ডালের বাইরেও কি যেন ছিল। সবজি জাতীয় কিছু? না-কি আলুর চপ?
বাবুর্চিকে ডেকে জেনে নেয়া যায়। এটা ঠিক হবে না। তাকেই বের করতে হবে।
শফিকুল করিম বারান্দায় বসে আছে। তাকে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে সে জানে না। এর মধ্যে যদি বাথরুম পায়, সে কী করবে? এক তলায় যাবে নাকি দোতলাতেও তার মতো কর্মচারীদের জন্যে কিছু ব্যবস্থা আছে? বারান্দায় বসে সিগারেট নিশ্চয়ই খাওয়া যাবে না। পানির পিপাসা হলে কী করবে? দোতলায় কেউ কি আছে যার কাছে পানি চাওয়া যাবে? তার কাজ কি বড় সাহেবের দৃষ্টির আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা? চাকরি ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয়? মীরাকে বলব চাকরিতে জয়েন করার পরপরই বড় সাহেব বললেন, তোমাকে দিয়ে আমার হবে না। তুমি চলে যাও। আমার ম্যানেজারের কাছ থেকে তিনদিনের বেতন নিয়ে যাও। আমি বেতন নেইনি।
মীরা খুবই মন খারাপ করবে তারপরেও কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বলবে, তিনদিনের বেতন না নিয়ে ভালো করেছ। তুমি কি ফকির নাকি?
সে বলবে, এখন চলবে কীভাবে?
মীরা বলবে, এত দুশ্চিন্তা করবে না। একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। তুমি তো মরুভূমিতে বসে নেই। তোমার টিউশনি আছে। কোচিং সেন্টারের পার্ট টাইম চাকরিটাও তো আছে।
দিনে আনি দিনে খাই চলতেই থাকবে?
চলুক। তুমি মুখ কালো করে থাকবে না। তোমার কালো মুখ দেখলে আমার খারাপ লাগে। চা বানিয়ে দিচ্ছি। চা খাও। তারপর চলো নিশোকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাই।
কোথায় বেড়াবে? রিকশা ভাড়া লাগবে না!
রাস্তায় হাঁটব। রাস্তায় হাঁটতে তো আর টাকা লাগবে না।
চলো হাঁটি।
চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকার সুবিধা হচ্ছে, মনে মনে অনেক গল্প তৈরি করা যায়। গল্পকে নানা দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। শফিকুল করিম এখন রাস্তায় হাঁটার দৃশ্য কল্পনা করছে। নিশো মাঝখানে, তার দুই হাত বাবা-মাকে ধরে রাখতে হচ্ছে। বাবা-মা দুজনই যেন তার ভালোবাসা সমানভাবে পায় এই বিষয়ে সে খুব হুঁশিয়ার। রিকশায় করে গেলে সে কিছুক্ষণ বসে মার কোলে। কিছুক্ষণ বাবার কোলে। ভালোবাসা ভাগাভাগির ব্যাপারে তার হিসাব পরিষ্কার।