জনাব আমি জানি না। আমাকে কেউ কিছু বলে নাই। ওনার সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ আছে?
না যোগাযোগ নেই। অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটা বড় হুজুর নিশ্চয়ই ক্ষমা করতেন না। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন এবং এই জাতীয় কোনো কিছু তার কানে যেত তাহলে অবশ্যই আমাকে ডেকে বলতেন, পশ্চিম দিকে ফিরে কানে ধরে পঞ্চাশ হাজার বার উঠবোস করো। বলতেন না?
জয়নাল সাহেব কিছু বললেন না। বলার মতো কিছু তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। মবিনুর রহমান খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, তবে লায়লার সঙ্গে আমার একবার যোগাযোগ হয়েছিল। তার মেয়ের জন্মের পরপরই হঠাৎ একদিন আমাকে মেয়ের জনের সংবাদ দিল এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সে মেয়ের জন্যে আমার কাছে সুন্দর একটা নাম চাইল। আমার মাথায় তখন কোনো নাম নেই। যেটা মনে এলো সেটাই বলেদিলাম।
জয়নাল সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, কী নাম দিলেন?
আমি তার নাম দিলাম আতর।
জয়নাল সাহেব বললেন, ওর নাম নীতু। ভালো নাম শায়রা হক।
মবিনুর রহমান বললেন, আমি জানি তার নাম নীতু এবং তার ভালো নাম শায়রা হক। আমার দেয়া নাম লায়লার পছন্দ হয়নি। পছন্দ হবার কথাও না। আচ্ছা ডিকশনারি বলুন তো হঠাৎ লায়লা কেন আমার কাছে মেয়ের নাম চাইল?
বলতে পারছি না জনাব। অনুমান করে বলুন।
জনাব আমার অনুমান খুবই খারাপ। বুদ্ধিমান মানুষ ভালো অনুমান করতে পারে। আমি বোকা কিসিমের।
মবিনুর রহমান টিভির দিকে তাকিয়ে আবারো দুলতে শুরু করলেন। দুলতে দুলতেই চাপা গলায় বললেন, মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানেন? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় লায়লার ঐ মেয়েটির বাবা আমি। এই সত্যটি লায়লা তার স্বামীর কাছে গোপন করে গেছে। আমাদের বিয়ে অতি অল্প সময়ের জন্যে হলেও আমরা কিছুক্ষণ একসঙ্গে ছিলাম। আচ্ছা থাক এই প্রসঙ্গ।
জয়নাল সাহেব বললেন, আপনি কি ওনাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন না?
মবিনুর রহমান চেয়ারে দুলতে দুলতে বললেন, পারি না। একলা যখন থাকি প্রায়ই ভাবি লায়লার মেয়েটি আসলে আমার। ভাবলে খুবই আনন্দ হয়। আমি এই আনন্দ নিয়ে আছি ভালো আছি। জিজ্ঞেস করে যখন জানব ঘটনা তা-না তখন কষ্ট পাব। খাল কেটে কষ্ট আনার দরকার কি। বলুন দরকার আছে?
জি না জনাব দরকার নেই।
মবিনুর রহমান বললেন, মুনশি ইদরিস সাহেব আমার জীবন ছারখার করে গেছেন। আমি মোটেই সাধুসন্ত না! সারাজীবন সাধুসন্তের জীবন-যাপন করে গেলাম। অনেকক্ষণ গল্প করলাম, এখন কাজের কথা সারি। আপনাকে আমি খুঁজছিলাম জরুরি কাজে।
জি জনাব বলুন।
অনেক দিন থেকেই আমি বাবুপুরা এতিমখানা চালাচ্ছি। এতিমখানার বর্তমান প্রিন্সিপাল সাহেব অসুস্থ। হাসপাতালে আছেন। আমি একজন নতুন প্রিন্সিপাল খুঁজছি। যিনি বড় হুজুর মুনশি ইদরিস সাহেবের মতো খাটি মানুষ।
জয়নাল সাহেব বললেন, এই যামানায় এমন মানুষ পাওয়া বড়ই কঠিন। মবিনুর রহমান বললেন, কঠিন হবে কেন? ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ সব জামানাতেই থাকে। থাকে না?
জি থাকে।
আপনার সন্ধানে কি কেউ আছে?
জি না জনাব।
মবিনুর রহমান বললেন, আপনি নিজেই তো আছেন। আপনি পারবেন না? ছাত্ররা আপনাকে ডাকবে ডিকশনারি হুজুর এটা খারাপ কি?
জয়নাল সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
মবিনুর রহমানের দৃষ্টি এখন টিভির দিকে। তিনি একটা হিন্দি চ্যানেল ধরেছেন। পুরনো দিনের কোনো একটা ছবি হচ্ছে। রাজা বাদশারন ছবি। নর্তকী নাচছে। কুৎসিত দর্শন এক প্রৌঢ় মদের গ্লাস হাতে আধশোয়া হয়ে নাচ দেখছে। ক্যামেরা এমন ভাবে ধরা হয়েছে যে প্রৌঢ়ের মুখ দেখা যাচ্ছে নর্তকীর দুপায়ের মাঝখান দিয়ে। মবিনুর রহমানকে দেখে মনে হচ্ছে দৃশ্যটা দেখে তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।
লায়লা সকাল থেকেই অপেক্ষা করছেন।
দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শোনার জন্যে অপেক্ষা। আগে দরজার কলিংবেল ছিল। বেল টিপলেই বিদেশী গানের সুর বাজত। এখন কলিংবেল নষ্ট। কেউ যদি বেল চাপে কোনো শব্দ হবে না। বাধ্য হয়ে তাকে কড়া নাড়তে হবে। লায়লা এই কড়া নাড়ার শব্দের জন্যেই অপেক্ষা করছেন।
আঙুল কাটা লোকমানের দশ দিনের সময়সীমা শেষ হয়েছে। এখন সে যে কোনো সময় আসবে। লায়লা স্কুলে যাননি। মেয়েকে একা বাসায় ফেলে স্কুলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে। নীতু রাজি হয়নি। সে মাকে ফেলে যাবে না।
আজ সকাল থেকে লায়লার মনে হচ্ছে তিনি একটা বড় ধরনের ভুল করেছেন। তার উচিত ছিল মেয়েকে সঙ্গে করে পালিয়ে যাওয়া। বাড়ির মায়া করা ঠিক হয়নি। তবে সেটাও সম্ভব হতো না। আঙুল কাটা লোকমানের লোকজন তাদের ওপর নজর রাখছে। তারা এটা হতে দিত না। লোকমানের সব লোকজনকে তিনি চেনেন না তবে একজনকে চেনেন। সে বেশির ভাগ সময় তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে যে চায়ের দোকান, সেখানে বসে থাকে। একদিন তার সঙ্গে কথাও হয়েছে। সে পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলেছে, খালাম্মা কই যান? ইস্কুলে?
তিনি জবাব দেননি। সে হাসি মুখে বলল, কিছু লাগলে বলবেন, আমি আছি।
তিনি বলেছিলেন, কিছু লাগবে না।
সে বলেছে, যখন দরকার হবে বলবেন। টাইম কোনো বিষয় না। আমি রাইতেও এই দোকানে থাকি। আওয়াজ দিলে চলে আসব। আমার নাম তুরা। নামটা মনে রাখেন খালাম্মা— তুরা।
তিনি বলেছিলেন, জানা থাকল।
বিপদে মানুষের বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়। তাঁর কি হয়েছে? হাতে দশদিন সময় পেয়েছিলেন। এই দশদিন কি তিনি নষ্ট করেননি?