বলিস কী? ঐ বেচারার সঙ্গে কি কথা বলা যাবে?
তার সঙ্গে তোমার কথা বলার কিছু নেই বাবা।
এক গ্লাস পানি খাব। পানি খাওয়াতে পারবি?
এসো আমার সঙ্গে পানি খাওয়াচ্ছি।
জয়নাল সাহেব বললেন, আমি এই কয়দিন কোথায় ছিলাম জানিস? শুনলে তুই অবাক হবি।
শফিক কিছু বলল না। এই ব্যাপারটাও জয়নাল সাহেবকে বিস্মিত করল। শফিক জানতেও চাচ্ছে না এই কয়দিন তিনি কোথায় ছিলেন। আশ্চর্য। শফিকের সঙ্গে নীতুর সমস্যাটা নিয়ে কথা বলা দরকার। কেনো বুদ্ধি কি সে দিতে পারবে না?
মবিনুর রহমান টিভির চ্যানেলে বদলে দিলেন। এখন চলছে ন্যাশনাল জিগ্রাফি চ্যানেল। পেঙ্গুইনদের কাণ্ডকারখানা দেখানো হচ্ছে। একটু আগে একদল মেয়ে নাচছিল এখন একদল পেঙ্গুইন নাচছে। কিংবা তারা হাঁটছে। হাঁটাই নাচের মতো লাগছে।
জয়নাল সাহেব!
জি জনাব।
আপনি কি আতরের গন্ধ পাচ্ছেন?
জি জনাব পাচ্ছি।
আতরটার নাম মেশকে আম্বর। বাবুপুরা এতিমখানার প্রিন্সিপাল মুনসি ইদরিস সাহেব এই আতর দিতেন। আমি কি ওনার কথা আপনাকে বলেছি?
জি না জনাব।
আমি যে এতিমখানায় বড় হয়েছি এটা কি জানেন?
জয়নাল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, জি না জনাব।
আমি বড় হয়েছি এতিমখানায়। এতিমখানা থেকেই মেট্রিক পাস করি। মেট্রিক পাস করার পর কারোরই এতিমখানায় থাকার নিয়ম নেই। বড় হুজুরের কঠিন নিয়ম, যেদিন রেজাল্ট আউট হবে সেদিনই এতিমখানা ছেড়ে চলে যেতে 61
মবিনুর রহমান সাহেব কথা শেষ করার আগেই জয়নাল সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, মেট্রিকে অপনার কি রেজাল্ট ছিল জানতে পারি?
আমি ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম, দুটা লেটার।
কোন দুই বিষয়ে লেটার পেয়েছিলেন?
অংকে পেয়েছিলাম আর ফিজিক্সে পেয়েছিলাম।
ইংরেজিতে কত নাম্বার ছিল?
মবিনুর রহমান হেসে ফেলে বললেন, আমার মনে নেই। আপনি চাইলে মার্কশিট খুঁজে বের করতে পারি। বের করব?
পরে দেখলেও চলবে। তবে দেখার ইচ্ছা হচ্ছে।
মবিনুর রহমান পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললেন, ডিকশনারি সাহেব আপনি কি সিগারেট খান?
জয়নাল সাহেব বললেন, জি না। তবে আপনার সিগারেট নিশ্চয়ই খুব দামি। এক দুইটা টান দিতে পারি। গতবার যখন এসেছিলাম তখন খেতে ইচ্ছা হয়েছিল লজ্জায় বলতে পারি নাই।
মবিনুর রহমান সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। নিজেই লাইটার জ্বালিয়ে ধরিয়ে দিলেন। জয়নাল সাহেব এই দ্রতায় মোহিত হলেন।
মবিনুর রহমান বললেন, এখন আমার ইন্টারেস্টিং গল্পটা বলি। মেট্রিকের রেজাল্টের পর আমি এতিমখানা ছেড়ে চলে যাব। বড় হুজুরের পা ছুঁয়ে সালাম করলাম, তিনি আমার হাতে একটা খাম দিলেন। তার নিয়ম ছিল এতিমখানা ছেড়ে চলে যাবার সময় তিনি সবার হাতে একটা করে খাম দিতেন। খামে টাকা থাকত। তখনকার সময় হিসাবে টাকার পরিমাণ বেশ ভালো ছিল { পাঁচ হাজার। টাকাটা তিনি কিভাবে জোগাড় করতেন কে জানে। এতিমখানার আয় বলতে কিছু ছিল না। যাই হোক আমি টাকাটা হাতে নিয়ে বললাম, বড় হুজুর আমার জন্যে একটু দোয়া করেন। আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দেন।
তিনি বললেন, যা ভাগ। আমি কারো জন্যে দোয়া করি না। নিজের দোয়া নিজে করবি।
আমি বললাম, আপনার দোয়া না নিয়ে আমি যাব না।
কি করবি, এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
কতদিন দাঁড়িয়ে থাকবি?
আপনি দোয়া না করা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকব। যতদিনই হোক।
তিনি বললেন, এক শর্তে দোয়া করতে পারি। শর্ত তো তুই মানতে পারবি না।
শর্ত মানব।
তিনি বললেন, জীবনে কোনো দিন মিথ্যা বলতে পারবি না। মিথ্যা না বলা হলো সুন্নতে রসূল। এই সুন্নত সারাজীবন পালন করতে হবে। পারবি?
আমি বললাম, পারব।
বড় হুজুর বললেন, পরের শর্তটা আরো কঠিন তবে প্রথম শর্ত পালন করতে পারলে পরেরটা সহজ হয়ে যায়। পরের শর্ত হলো জীবনে কোনো অন্যায় করতে পারবি না।
আমি বললাম, এটাও পারব।
তিনি আমার মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দোয়া করলেন। দোয়া শেষ করে পাঞ্জাবির পকেট থেকে আতর বের করে তুলা দিয়ে আমার শার্টে খানিকটা লাগিয়ে দিয়ে বললেন, যা ভাগ। চড়ে খা।
বড় হুজুরের এই পাঁচ হাজার টাকা দিয়েই আমার জীবনের অর্থবিত্তের শুরু। গল্পটা কি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে?
জি জনাব। আপনার বড় হুজুর কি জীবিত আছেন?
না। আমি এতিমখানা ছেড়ে চলে আসার পরের বছরই তিনি মারা যান।
জয়নাল সাহেব ইতস্তত করে বললেন, আপনাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল। প্রশ্ন করার সাহস হচ্ছে না।
মবিনুর রহমান বললেন, আপনার প্রশ্নটা আমি অনুমান করতে পারছি। আপনি জানতে চাচ্ছেন বড় হুজুরের শর্ত আমি পালন করতে পেরেছি কিনা। তাই তো?
জি জনাব।
আমি দুটা শর্তই পালন করতে পেরেছি। এখনো পারছি। আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করেছে?
জি করেছি।
সিগারেট খেয়ে আপনি মনে হয় মজা পাচ্ছেন না। ফেলে দিন।
জয়নাল সাহেব সিগারেট ফেলে দিলেন। মবিনুর রহমান বললেন, আপনার পাঞ্জাবিতে কি একটু আতর লাগিয়ে দেব?
আপনার ইচ্ছা হলে দিন।
মবিনুর রহমান পকেট থেকে আতরের শিশি থেকে খানিকটা অতির জয়নাল সাহেবের পাঞ্জাবিতে লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন, আপনি তো এই কয়দিন লায়লার বাড়িতে ছিলেন। আপনি কি জানেন লায়লার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল?
জয়নাল বিস্মিত হয়ে বললেন, জানি না তো?
কেউ আপনাকে বলেনি?
জি না জনাব।
খুব অল্প সময়ের বিয়ে। সাত ঘণ্টা সময়সীমা।