ফজলু বলল, স্যার কাজটা বলেন।
আজ সন্ধ্যার মধ্যে একজনকে আমার সামনে উপস্থিত করবে। তার নাম লোকমান। লোকে ডাকে আঙুল কাটা লোকমান। নারায়ণগঞ্জের আঙুল কাটা লোকমান।
স্যার আমি সন্ধ্যার আগেই তাকে উপস্থিত করব।
মবিনুর রহমান টেলিফোন রেখে দিলেন।
জয়নাল সাহেবের মধ্যে জবুথুব ভাব
জয়নাল সাহেবের মধ্যে জবুথুব ভাব চলে এসেছে। তিনি কুঁজো হয়ে মবিনুর রহমানের সামনে বসে আছেন। মবিনুর রহমান তাকিয়ে আছেন টিভির দিকে। টিভিতে নাচের দৃশ্য হচ্ছে। বিশ-পঁচিশটা মেয়ে নাচানাচি করছে। সবার হাতে সাদা ওড়না। শুধু একটি মেয়ের হাতে লাল ওড়না। সেই মেয়েটি মনে হয় নাচের দলের লিডার। তাকে ঘিরেই বাকি মেয়েগুলো নাচছে। টিভিতে কোনো শব্দ হচ্ছে না। জয়নাল সাহেব আড়চোখে মাঝে মধ্যে টিভির দিকে তাকাচ্ছেন। আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনছেন মবিনুর রহমানের দিকে। ঠাণ্ডা লেগে তার কাশির ভাব হয়েছে। তিনি কাশতে পারছেন না। তাঁর মনে হচ্ছে কাশির শব্দে মবিনুর রহমান বিরক্ত হবেন। কাশি আটকাতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে।
মবিনুর রহমান ঘাড় ফিরিয়ে জয়নাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভালো আছেন?
জয়নাল সাহেব বললেন, জি জনাব। তবে গত রাতে ঠাণ্ডা লেগে কফের মতো হয়েছে। এ ছাড়া ভালো আছি।
কথাগুলো বলে তিনি সামান্য সংকুচিত হলেন। তাঁর জবুথবু ভাব আরো প্রবল হলো। কারণ তিনি মিথ্যা ভাষণ করেছেন। তাঁর ঠাণ্ডা লেগেছে এটা সত্যি তবে তিনি ভালো আছেন এটা সত্যি না। তিনি ডিকশনারিটা হারিয়ে ফেলেছেন। দীর্ঘদিনের সঙ্গী হারিয়ে গেলে মন ভালো থাকে না। ডিকশনারিটা কোথায় হারিয়েছেন তিনি মনে করতে পারছেন না। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় অসিৗর পথে ডিকশনারি তার হাতে ছিল এটা মনে আছে। তিনি ডিকশনারির পাতা উল্টাচ্ছেন এটাও মনে আছে। তখন একটা শব্দ চোখে পড়ল— Shoddy যার অর্থ Poor quality. শব্দটা পড়ে তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করেছিলেন এই পর্যন্ত ঠিক আছে। বাস থেকে নামার পথে ডিকশনারি হাতে ছিল কিনা তা আর মনে পড়ছে না। বাস্ থেকে নেমে তিনি কি কি করেছেন ভাবতে শুরু করলেন। সময় কাটুক। কাশি চেপে বসে থাকা ছাড়া তো তার এখন কিছু করার নেই।
বাস থেকে নেমে তিনি রিকশী করে পুলিশ কমিশনার সাহেবের বাড়িতে গেলেন। মইনের সঙ্গে দেখা করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন তার স্ত্রী কেয়ার সঙ্গে কথা বলবেন। মেয়েদের মন নরম হয়। একটি মেয়েই অতি দ্রুত অন্য একটি মেয়ের সমস্যা ধরতে পারে। তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন নীতুর সমস্যাটা যতদূর সম্ভব গুছিয়ে কেয়াকে বলবেন। আঙুল কাটা লোকমান দশদিন সময় দিয়েছিল। সেই দশদিন আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। যা করার আজকের মধ্যেই করতে হবে। কেয়াকে সমস্যাটা ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতে পারলে আর কিছুই লাগবে না। সে তার স্বামীকে চেপে ধরবে। পৃথিবীতে স্ত্রী জাতির ক্ষমতা স্বীকৃত। সিংহাসনে যিনি বসে থাকেন তিনি রাজ্য চালান না। রাজ্য চালান তাঁর স্ত্রী। মোঘল আমলেই এর উদাহরণ আছে। সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসে থাকতেন। সাম্রাজ্য চালাতেন তার স্ত্রী নূরজাহান।
কেয়ার সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারলেন না। এই ব্যাপারটাও কিছু রহস্যময়। প্রথমে তাকে বলা হলো ম্যাডাম বাসায় আছেন। কি জন্যে এসেছেন? নাম কী? কেন দেখা করতে এসেছেন এটা আগে বলতে হবে। তিনি সবই বললেন। তখন তাকে গেটে দাঁড় করিয়ে রেখে পুলিশের গার্ড ভেতরে গেল এবং ফিরে এসে বলল, ম্যাডাম বাসায় নেই। আপনে পরে আসুন।
তিনি বললেন, পরে কখন আসব?
পুলিশ গার্ড বলল, সন্ধ্যার দিকে আসুন।
কেয়া কি ইচ্ছা করে দেখা করল না? এটা হতেই পারে না। তার ধারণা পুলিশের গার্ড এখানো কোনো চাল চেলেছে। তার সঙ্গে তর্কে-বিতর্কে না গিয়ে তিনি সন্ধ্যায় আবার যাবেন বলে ঠিক করে শফিকের বাসায় গেলেন। সেখানে গিয়ে শুনেন শফিক বাসা ছেড়ে দিয়েছে। নতুন বাসা নিয়েছে। সেই বাসার ঠিকানা বাড়িওয়ালা জানে না। তিনি শফিকের খোঁজে চলে এলেন মবিনুর রহমানের বাড়িতে। বাড়ির গেট দিয়ে ঢোকার সময় প্রথম লক্ষ্য করলেন হাতে ডিকশনারি নেই। তার বুক ছ্যাৎ করে উঠল।
এই বাড়িতে ঢুকতে কোনো সমস্যা হয়নি। বাড়ির গার্ড তাঁকে সালাম দিয়ে ঢুকিয়ে গেট বন্ধ করে দিয়েছে। শফিকও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর কাছে এসে বলেছে, বাবা তুমি ওপরে যাও। বড় সাহেব তোমার খোঁজ করছেন। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন? শফিক বলল, কেন আমি জানি না।
তিনি বললেন, কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?
শফিক বলল, কোনো ঝামেলা হয়নি।
তিনি বললেন, চারদিকে এত লোকজন কেন?
শফিক বলল, এখানে সব সময় প্রচুর লোকজন থাকে।
তিনি বললেন, বিরাট একটা ক্ষতি হয়েছে বুঝলি, ডিকশনারিটা হারিয়ে ফেলেছি।
শফিক বলল, ডিকশনারি হারিয়ে ফেলেছ আবার কিনে দেয়া যাবে। তুমি বড় সাহেবের কাছে যাও। উনি খুব ব্যস্ত হয়ে তোমাকে খুঁজছেন।
ততক্ষণে তার চোখে পড়ল বারান্দার এক কোনায় বয়স্ক চশমা পরা এক লোক কানে ধরে উঠবোস করছে। লোকটার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম পড়ছে।
জয়নাল সাহেব ভীত গলায় বললেন, ঐখানে কী হচ্ছে?
শফিক বলল, শাস্তি দেয়া হচ্ছে।
কাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে?
ওনার নাম আমজাদ আলি। বড় সাহেব ওনাকে কানে ধরে পঞ্চাশ হাজার বার উঠবোস করতে বলেছেন।