নটি শব্দের অর্থ বলা হয়েছে। দশ নাম্বার শব্দ। এটা পারলেই রুমা বাজিতে হারবে। জয়নাল সাহেব লক্ষ্য করলেন টেনশানে মা-মেয়ে দুজনই ঘামছে। তারা কি ধরেই নিয়েছে দশ নম্বর শব্দের অর্থ তিনি পারছেন না।
রুমা বলল, চাচা শেষ শব্দ— Garet.
জয়নাল সাহেব বললেন, মা Garet শব্দের মানে হলো বাড়ির মাথায় ছোট্ট ঘর। চিলেকোঠা। আমি এখন যে ঘরে থাকি সেই ঘর। মাগো তুমি কি বাজিতে হেরেছ?
রুমা বলল, জি চাচা।
নীতু এবং লায়লা দুজনের মুখেই বিজয়ীর হাসি। যেন দশটা শব্দের অর্থ মামেয়ে দুজনে মিলেই দিয়েছে।
মবিনুর রহমান বারান্দায় বসে আছেন। শফিক তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। সে অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। মবিনুর রহমান তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন; কিন্তু কিছু বলছেন না। একবার শফিকের মনে হলো স্যার বোধহয় ভুলে গেছেন যে শফিক সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। শফিক বুঝতে পারছে না সে কি তার উপস্থিতি বোঝানোর জন্যে কোনো কিছু করবে? স্যারের চোখ বন্ধ। একেকবার তিনি যখন চোখ বন্ধ রাখেন অনেকক্ষণের জন্যে বন্ধু রাখেন।
মবিনুর রহমান বললেন, তোমার বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে বাবুল?
শফিক বলল, জি না স্যার।
হোটেলে খোঁজ নিয়েছিলে?
জি স্যার।
উনি কি মাঝে মাঝে উধাও হন।
জি কয়েকবার হয়েছেন।
আমিও সেরকমই ভেবেছিলাম। তুমি যদি তোমার বাবার কোনো খোঁজ পাও তাকে বলবে যেন আমার সঙ্গে দেখা করেন।
জি স্যার বলব।
আমজাদ আলির শাস্তি কি বন্ধ আছে?
স্যার ওনার শরীর খারাপ। পা ফুলে পানি এসে গেছে।
মবিনুর রহমান পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন— আমজাদ তার শাস্তি শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় না। টিমে তেতালায় উঠবোস করলে চলবে কীভাবে? দিনে একশবার করে করলে তার লাগবে পাঁচশ দিন। প্রায় দেড় বছর। বাবুল হিসাব ঠিক আছে?
জি স্যার।
আমজাদ আলিকে বলে দাও সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছি— চার মাস। তাকে চার মাসে শেষ করতে হবে। আজই তার বাসায় খবর পাঠিয়ে দেবে।
জি স্যার।
তোমার সঙ্গে কাগজ-কলম আছে?
জি স্যার আছে।
এখন অন্য একটা হিসাব করো। যেসব কাজ আমি তোমাকে করতে বলেছি এবং তুমি করোনি তার তালিকা।
শফিক অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। বড় সাহেব তাকে কোনো কাজ দিয়েছেন সে করেনি এমন কিছু সে মনে করতে পারছে না।
মবিনুর রহমান বললেন, লেখো এক নাম্বার তোমাকে ডাল রান্না করতে বলেছিলাম। করোনি।
দুই নাম্বার, করলা ভাজি নিয়ে একটা কথা বলেছিলাম। তুমি করলা ভাজি খাবে আমি দেখব। সেটা করোনি।
তিন নাম্বার, আমি বলেছিলাম তোমার মেয়ে নিশোকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তুমি আনোনি।
চার নাম্বার, লায়লার সঙ্গে যাতে যোগাযোগ রাখতে পারো তার জন্যে তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে গাড়ি দিয়েছিলাম তুমি একবার মাত্র গিয়েছ। তাও সে যখন তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। ঠিক বলেছি বাবুল?
জি স্যার।
আমার কাজ করার জন্যে তুমি যে আনফিট তা কি বুঝতে পারছ?
শফিক চুপ করে আছে। মবিনুর রহমান আগের মতো মাথা দুলাচ্ছেন। হঠাৎ দুলানো বন্ধ করে বললেন, তুমি তোমার বাবার খোঁজ লায়লার কাছে পাবে বলে আমার ধারণা। লায়লা রান্না করে তাকে তরকারি পাঠিয়েছে। শিং মাছের ডিম। তোমার বাবা যে রকম মানুষ তিনি ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে অবশ্যই লায়লার কাছে যাবেন। আমি যদি শুনি তিনি লায়লার অতিথি হয়ে ঐ বাড়িতেই বাস করছেন আমি মোটেই অবাক হব না।
শফিকের শরীর ঝিমঝিম করছে। সে নিশ্চিত এই অর্ধউন্মাদ মানুষ কানে ধরে উঠবোসের ব্যাপারটা তাকে দিয়েও করাতে চাইবে। এটা তার এক ধরনের খেলা। এই বৃদ্ধ তাকে নিয়ে অবশ্যই খেলতে চাইবে। তার জন্যে এটাই স্বাভাবিক।
বাবুল।
জি স্যার।
কোম্পানির ফ্ল্যাটে উঠেছ শুনলাম। ফ্ল্যাট পছন্দ হয়েছে?
জি স্যার।
তোমার স্ত্রীর পছন্দ হয়েছে?
জি স্যার।
তোমার স্ত্রীর নাম যেন কী?
মীরা।
ও হা মীরা। তোমার এবং তোমার কন্যার নাম মনে রাখার জন্যে একটা ব্যবস্থা করেছিলাম বলে তাদের নাম মনে আছে। তোমার স্ত্রীর নাম রাখার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি বলে তার নাম প্রতিবার জিজ্ঞেস করতে হয়। আচ্ছা বাবুল শোনো, যারা আমার জন্যে কাজ করে আমি তাদের জন্যে অনেক কিছু করি। ঠিক না?
জি স্যার।
কখনো কি ভেবেছ কেন করি?
শফিক চুপ করে রইল। মবিনুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, আমার যেহেতু কেউ নেই— যারা আমার কাছে তাদেরকেই আপনজন মনে করি। আমি মনে করি তাদেরকে নিয়েই আমার সংসার। এতিমখানায় যখন ছিলাম তখন এতিমখানার সবাইকে আমার সংসার মনে হতো। এখন বুঝেছ?
জি স্যার।
এতিমখানায় আমি একবার একটা বড় অন্যায় করেছিলাম। আমাদের হুজুর মুন্সি ইদরিস আলি আমাকে দশ হাজার বার পশ্চিম দিকে ফিরে কানে ধরে উঠবোস করতে বললেন। সময় বেঁধে দিলেন— তিন দিন। আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন কী হলো জানো? এতিমখানার সবাই এগিয়ে এলো। তারা শাস্তি শেয়ার করবে। বড় হুজুর তাতে রাজি হয়েছিলেন। ইন্টারেস্টিং না?
জি স্যার।
তুমি ক্যাশিয়ার সোবাহানকে বল, আমজাদ আলির হয়ে অন্য কেউ যদি শাস্তি নিতে চায় আমি তাতে রাজি আছি। সেই ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ কমাতেও পারি। এখন তুমি আমার সামনে থেকে যাও। যাবার আগে সেলফোনটা দিয়ে যাও। একটা জরুরি টেলিফোন করব।
মবিনুর রহমান টেলিফোনে ফজলু নামের একজনকে ধরলেন। মবিনুর রহমান বললেন, ফজলু একটা কাজ করে দিতে হয় যে।