আঙুল কাটা লোকমান লায়লার কাছে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। লায়লার পা ছুঁয়ে সালাম করে অতি বিনয়ের সঙ্গে বলেছে— খালাম্মা আপনার মেয়েকে বিবাহ করতে চাই। কোনো জোর-জবরদস্তি না। আপনার অনুমতি এবং দোয়া নিয়ে বিবাহ। আপনার মেয়ে সুন্দরী? তার প্রটেকশান দরকার। প্রটেকশান না দিলে দেখা যাবে কোনো দিন কে মুখে এসিড মেরে দিয়েছে। আমি তখন আটকাতে পারব না। আপনাকে চিন্তাভাবনা করার সময় দিলাম খালাম্মা। ভালোমতো চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিবেন। বিবাহের যাবতীয় খরচ আমার। মেয়ের নামে আমি একটা বাড়ি লেখাপড়া করে দিব। আপনিও মেয়ের সঙ্গে থাকবেন। এই আমার শেষ কথা। দশদিন পরে আবার এসে আপনার সিদ্ধান্ত শুনব। যদি কোনো বেয়াদৰি করে থাকি তার জন্য ক্ষমা চাই। আঙুল কাটা লোকমান লায়লার পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় হলো।
দশদিন পার হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। লায়লা ভেঙে পড়েছেন। নীতুর ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। সে চব্বিশ ঘণ্টাই ঘরে থাকে।
জয়নাল সাহেব ঘটনা সবাই শুনেছেন। তিনি যে লায়লাদের সঙ্গে থাকছেন তার প্রধান কারণ এটাই। একটা পরিবারকে এমন অসহায় অবস্থায় রেখে তিনি চলে যেতে পারেন না। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না যে এদের টাকাপয়সাও নেই। নীতুর বাবা মৃত্যুর আগে ধারদেনা করে শুধু এই বাড়ি বানিয়ে যেতে পেরেছেন। এই বাড়ি নিয়েও সমস্যা। একজন পুরনো দলিল বের করেছে। দলিলে দেখা যাচ্ছে যে জমিতে এই বাড়ি সেই জমি তার। অন্যের জমিতে জবরদখল করে বাড়ি করা হয়েছে। এই নিয়ে কোর্টে মামলা চলছে। লায়লা একা কোর্ট-কাচারি করছেন। স্কুলে যাচ্ছেন। সপ্তাহে তিন দিন বাড়িতে ছাত্র পড়াচ্ছেন। তারপরেও দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা।
লায়লা জয়নাল সাহেবকে বলছেন, ডিকশনারি ভাই আপনি যে কয়েকদিন আমার এখানে আছেন তাতে আমার মেয়ে যেমন খুশি আমি তার চেয়েও খুশি। বুকে ভরসা হয় যে একজন কেউ মেয়েটার সঙ্গে আছে। স্কুলে যখন যাই সারাক্ষণ বুক ধড়ফড় করে মেয়েটা বাসায় একা।
জয়নাল সাহেব বলেছেন, আপনি মেয়ের বিষয় নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবেন না। আমি সব ফয়সালা করে তারপর যাব। তার আগে না।
লায়লা বিস্মিত হয়ে বলেছেন, আপনি কীভাবে ফয়সালা করবেন?
জয়নাল সাহেব তৃপ্তির হাসি হেসে বলেছেন, ঢাকা সাউথের পুলিশ কমিশনার আমার ছাত্র। আমাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। তার নাম মইল। তার স্ত্রীর নাম কেয়া। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে জিওগ্রাফিতে মাস্টার্স করেছে। তাদের একটাই ছেলে ছেলের নাম টগর। সানবিম নামের একটা ইংরেজি স্কুলে পড়ে। অতি বুদ্ধিমান ছেলে। আমি শুধু মইনকে ঘটনাটা জানাব। আঙুল কাটা লোকমান পায়ে ধরে কূল পাবে না।
লায়লা হতাশ গলায় বলেছেন, পুলিশ এইসব ক্ষেত্রে কিছুই করে না।
জয়নাল সাহেব বলেছেন, আপনি ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দেন। দেখেন পুলিশ কিছু করে কিনা। আমি মইনকে সাথে করে নিয়ে আসব। সে ফেরত যাবে আঙুল কাটা লোকমানকে নিয়ে।
আপনার কাছে পৃথিবীটা এত সহজ?
সহজ তো অবশ্যই।
আপনি ছাত্রের কাছে কবে যাবেন?
যেতেও হবে না আমি টেলিফোন করলেই ঘটনা ঘটে যাবে। যে কোনো একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে টেলিফোন করব তার দুই ঘণ্টার মধ্যে দেখবেন বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি। মইনের টেলিফোন নাম্বার আমার মুখস্থ। মোবাইল নাম্বারও আছে আবার টিএন্ডটির নাম্বারও আছে।
তাহলে দেরি করছেন কেন? টেলিফোনটা করে ফেলুন।
জয়নাল সাহেব টেলিফোন করেছিলেন। পুলিশ কমিশনার মইন টেলিফোন ধরেছেন এবং শীতল গলায় বলেছেন, স্যার এইসব ঝামেলায় আপনি জড়াবেন না। আপনি কথা শুনুন, ঢাকায় চলে আসুন।
ঢাকায় চলে আসব?
অবশ্যই! আপনি বৃদ্ধ মানুষ আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় যাবেন কেন?
এদেরকে এইভাবে ফেলে রেখে চলে আসব?
অবশ্যই।
পুলিশ কিছুই করবে না। তাহলে তোমরা পুলিশরা আছ কী জন্যে?
স্যার পুলিশ কি করবে না করবে সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না।
তুমি আমার ছাত্র না হলে তোমাকে একটা খারাপ কথা বলতাম। ছাত্র এবং পুত্র এই দুই শ্রেণীকে কখনো কোনো খারাপ কথা বলা যায় না।
আমাকে খারাপ কোনো কথা বললে যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে খারাপ কথা বলুন। শুধু দয়া করে আমার কথাটা শুনুন— ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে আসুন। আঙুল কাটা লোকমান ভয়ংকর সন্ত্রাসী। সে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জয়নাল সাহেব লায়লাকে বলতে পারেননি যে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি ব্যাপারটা গোপন রেখেছেন। তবে তাঁর মাথায় অন্য একটা পরিকল্পনা এসেছে। মা-মেয়ে দুজনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া।
শফিকের বাসায় নিয়ে তুলবেন। ভয় মনোয়ারাকে নিয়ে। একবার যদি তার মুখ ছুটে যায় তাহলে সে কি বলবে না বলবে তার ঠিক নেই। আরেকটা বুদ্ধি আছে— তার বড় মেয়ে সুরমার কাছে নিয়ে যাওয়া। সুরমা অতি ভালো মেয়ে। বিপদগ্রস্ত একটা পরিবারকে সে দূরে ফেলে দেবে না।
জয়নাল সাহেব বাজির পরীক্ষা দিচ্ছেন। রুমা নামের মেয়েটা কঠিন কঠিন শব্দই কাগজে লিখে এনেছে। সে যাই আনুক কোনো সমস্যা জয়নাল সাহেবের নেই। সবই তাঁর মুখস্থ। তারপরও একেকবার রুমা শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি চিন্তিত ভঙ্গি করেন। যেন শব্দের অর্থ তার মনে পড়ছে না এই কাজটা তিনি করছেন নীতু এবং তার মার জন্যে। তারা দুজনই টেনশানে মরে যাচ্ছে। মামেয়ে দুজনের ভাব এ রকম যেন তিনি শব্দের অর্থ না পারলে পরাজয়টা তাদের।