দুটা খাট এবং একটা সোফাসেট দরকার। এইসব কেনা গেল না। মীরা ঠিক করে ফেলল যেভাবেই হোক সামনের মাসে সে এই দুটা জিনিস কিনবেই। প্রয়োজনে গলার হারটা বিক্রি করবে। তার সব গয়না বিক্রি হয়ে গেছে। এই হারটা শুধু আছে। লুকানো আছে। শফিকও জানে না। জানলে অনেক আগেই বিক্রি হতো। ভাগ্যিস বিক্রি হয়নি। এখন কাজে লাগবে। মানুষ অভাবে পড়লে গয়না বিক্রি করে। সে বিক্রি করবে সুসময়ে।
নিশোর অনেক দিনের শখ মেটানোর জন্য ইনসটলমেন্টে একটা ফ্রিজ কেনা হয়েছে। নিশো সবাইকে বলছে, ফ্রিজটা আমার একার। ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি যদি কেউ খেতে চায় আগে আমাকে বলতে হবে। আমি পানি ঢেলে দেব। আমাকে না বলে কেউ ফ্রিজেও হাত দেবে না।
মীরার ধারণা বাড়ি দেখে আনন্দে যে মানুষটা সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলতেন তিনি নিশোর দাদাজান। তাঁর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এক রাত ছেলের বাড়িতে কাটিয়ে ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে তিনি যে বের হয়েছেন আর বাড়িতে ফিরে আসেননি। আগের হোটেলেও যাননি। শফিক নানা জায়গায় তাকে খোজাখুঁজি করছে। কেউ কিছু বলতে পারছে না। এটা নিয়ে মনোয়ারা মোটেই চিন্তিত না। তিনি মীরাকে বলেছেন, তোমার শ্বশুর কোথায় আছে আমি জানি। তোমরা খামখা অস্থির হয়ো না।
মীরা ভীত গলায় বলল, উনি কোথায় আছেন?
হোটেলে থাকার সময় বাজারের কোনো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে।
আম্মা এইসব কি বলেন?
পুরুষ জাতিকে আমি চিনি। তুমি চেন না। যেটা বললাম এটাই সত্যি। শফিককে নিষেধ করে দিবে খামখা যেন ছোটাছুটি না করে।
জি আচ্ছা নিষেধ করব।
মীরা এই প্রথম তার নিজের সংসারের জন্যে কাজের মেয়ে রেখেছে। মেয়েটার নাম ফুলি। বয়স বারো-তের। প্রচুর কাজ করতে পারে। তাকে দিয়ে কাজ করানোর সময় মীরার একই সময় একটু লজ্জা লজ্জা লাগে আবার অহংকারও হয়। ফুলিকে সে মাঝে মাঝে উপদেশ দেয়। তখন নিজেকে অনেক বড় মনে হয়। মনে হয় তার অনেক ক্ষমতা।
ফুলি শোন, মন দিয়ে কাজ করবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। অবসর সময়ে আমার শাশুড়ির সেবা করবে। তোমার কিসে ভালো হয় সেটা আমি দেখব। বিয়ের বয়স হোক, ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব। ঠিক আছে?
জি আম্মা ঠিক আছে।
আমাকে আম্মা ডাকবে না। আমাকে ডাকবে আপা আর নিশোর বাবাকে ডাকবে ভাইজান। নিশোকে ডাকবে নিশো মামণি।
আগে মীরার দুপুরে ঘুমের অভ্যাস ছিল না। এখন ঘুমের অভ্যাস হয়েছে। রোজ দুপুরে ফ্যান ছেড়ে মেঝেতে পাটি পেতে সে কিছুক্ষণ ঘুমায়। সেই সময় ফুলি মাথায় তেল দিয়ে চুল টেনে দেয়। আরামে মীরার শরীর অবশ হয়ে আসে। মীরার মনে হয় তার মতো সুখী মেয়ে ঢাকা শহরে নেই।
এর মধ্যে একদিন মীরা বাথটাবে গোসল করেছে। সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো স্নান। বাথটাব ভর্তি ফেনা মেশানো পানি। সে গলা ড়ুবিয়ে শুয়ে আছে। শরীর ফেনার নিচে রাখতে হচ্ছে কারণ সিনেমার নায়িকাদের মতো তার গায়েও কোনো কাপড় নেই। শুরুতে খুব লজ্জা লাগছিল। পরে আর লাগেনি। মীরা ঠিক করে রেখেছে শাশুড়ি যেদিন থাকবেন না সেদিন শফিককে নিয়ে একসঙ্গে বাথটাবে গোসল করবে। সেদিন নিশোকেও বাড়িতে রাখা যাবে না। কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে। মেয়ে ভীষণ পাজি হয়েছে, সবাইকে বলে দেবে বাবা-মা একসঙ্গে গোসল করেছে। কাজের মেয়েটাকেও সেদিন বাসায় রাখা ঠিক হবে না।
একদিন মঞ্জু মামা এসেছিলেন ফ্ল্যাট দেখতে। তাঁকে ঠিকানা দেয়া হয়নি। তিনি খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলেছেন। ফ্ল্যাট দেখে তিনি মুগ্ধ।
মীরা বলল, মামা এগুলি হচ্ছে কোম্পানির থার্ড ক্যাটাগরির ফ্ল্যাট। সেকেন্ড ক্যাটাগরিগুলি আরো অনেক সুন্দর। সব রুমে এসির ব্যবস্থা।
মঞ্জু মামা বললেন, তাহলে ফার্স্ট ক্যাটাগরির ঘটনা কী? কারা থাকে সেখানে?
কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার টাইপের অফিসাররা। ইন্ডিপেনডেন্ট বাড়ি। বাড়ির সামনে লন আছে। ফুলের বাগান আছে। ফুলের বাগানের জন্যে মালি আছে।
বলিস কী? শফিক জেনারেল ম্যানেজার হবে কবে?
মীরা বলল, জানি না কবে হবে। যা হয়েছে এতেই আমি খুশি। আচ্ছা মামা সেকেন্ড হেল্ড এসি কোথায় পাওয়া যায় কত দাম কিছু জানো? ভাবছি একটা এসি লাগাব। ও গরমে ঘুমাতে পারে না। কষ্ট করে। অফিসে সারাদিন পরিশ্রম করে। রাতে ঘুম দরকার।
এসি লাগাবি যখন নতুন লাগা। আমি খোঁজ-খবর করে দেখি কোন কোম্পানি ভালো।
মীরা গাঢ় গলায় বলল, দেখো খোঁজ নিয়ে।
তোদের টেলিফোন আছে না? নাম্বার দে নিয়ে যাই।
নাম্বার এখনো লাগেনি মামা। এক সপ্তাহের মধ্যে লাগবে।
বাথরুম কয়টা?
তিনটা বাথরুম। বাথটাব আছে। হট ওয়াটারের সিস্টেম আছে।
কথাগুলি বলে মীরা কি যে আনন্দ পাচ্ছে। টাকা ধার করার জন্যে কতবার উনার কাছে যেতে হয়েছে। একবার সে দুই গাছি সোনার চুড়ি নিয়ে গিয়েছিল। মঞ্জু মামা যদি কোথাও চুড়ি বন্ধক রেখে কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। মামা চুড়ি রাখেননি। চুড়ি তার হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন। চুড়ি পরানোর সময় কি বিশ্রীভাবেই না হাত ধরলেন। তখন মীরার ইচ্ছা করছিল মঞ্জু মামাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে। সে সরিয়ে দিতে পারেনি। তার টাকার দরকার ছিল। টাকা খুবই বড় জিনিস।
মঞ্জু মামা।
বল।
তুমি কিন্তু আজ দুপুরে খেয়ে যাবে। আমাদের নতুন কাজের মেয়ে ফুলি নাম। তার বয়স অল্প হলেও রাধে ভালো। কি খেতে চাও মামা বলো। পোলাও রাধব?