এক কাপের জায়গায় শফিকুল করিম দুকাপ চা শেষ করল। দুকাপ চায়ের সঙ্গে তিনটা সিগারেট। সোবাহান মিয়া সারাক্ষণই কথা বলে যেতে থাকলেন। তার মনে হয় কথা বলার রোগ আছে।
আপনি যে এসেছেন সেই খবর আমি মোবাইল টেলিফোনে স্যারকে দিয়ে দিচ্ছি। আপনি দোতলার বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকবেন। খবরের কাগজ-টাগজ পড়বেন। স্যার যদি ম্যানেজার বলে ডাক দেন, তবেই ঘরে ঢুকবেন। না ডাকলে ঢুকবেন না।
আমার পোস্টটা কী? ম্যানেজারের পোস্ট?
এই রকমই কিছু ধরে নেন।
আমজাদ সাহেব যিনি উঠবোস করছেন, তিনি কি এই পোস্টেই ছিলেন?
হ্যাঁ। আপনি উনার জায়গাতেই এসেছেন।
আমজাদ সাহেবের শাস্তি শেষ হলে উনি চাকরি ফেরত পাবেন। তখন কি আমার চাকরি চলে যাবে?
মনে হয় চলে যাবে! স্যার কখনো প্রয়োজনের বেশি স্টাফ রাখেন না। আপনি লে যনি দোতলায়। আমি খবর দিয়ে দিচ্ছি। দুপুরে যখন খেতে আসবেন ঘরের চাবি নিয়ে যাবেন।
মবিনুর রহমান বসে আছেন তাঁর শোবার ঘরের একমাত্র চেয়ারটায়। এটা একটা রকিং চেয়ার। পা রাখার জন্যে ফুট-রেস্ট আছে। ফুট-রেস্টে পা রেখে চেয়ার যখন দোলানো হয়, তখন ফুট রেস্টটাও সমান তালে দোলে। আরামদায়ক ব্যবস্থা। তারপরেও তিনি কোনো আরাম পাচ্ছেন না। তিনি পিঠের পেছনে একটা বালিশ দিয়েছেন। বালিশটা দেয়ার পর পর তাঁর মনে হয়েছিল, এইবার আরাম হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, পিঠের পেছনে বালিশ দেয়াটা বোকামি হয়েছে। বোকামি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ঠিক করতে হয় না। বোকামিটাকে প্রবাহিত হতে দিতে হয়। তিনি তাই করছেন, বোকামিটাকে প্রবাহিত হতে দিচ্ছেন।
তিনি চেয়ারে দুলতে দুলতে তাকিয়ে আছেন টিভির দিকে। তাঁর ঘরের টিভিটা বিশাল। ডায়াগোনালি, পর্দার সাইজ ৬৪ ইঞ্চি। টিভির সঙ্গে দেয়া হ্যান্ডবুকে লেখা আছে— পর্দার ছবি সবচে ভালো দেখার জন্যে দর্শককে পর্দা থেকে বিশ ফুট দূরে বসতে হবে। তিনি গজফিতা দিয়ে মেপে তার রকিং চেয়ার ঠিক বিশ ফুট দূরে বসিয়েছেন। দোল খাওয়ার সময় চেয়ার একটু আগুপিছু হয়। কতটুকু আগুপিছু হয় সেটাও মাপিয়েছেন। ০৩ ফুট। কাজেই তাঁর পজিশন ২০৩ ফুট।
টিভিতে রান্নাবান্নার একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। ঝলমলে শাড়ি-গয়না পরা অতি রূপবতী এক তরুণী পিজা বানাচ্ছে। তরুণীকে সাহায্য করছে আরো দুজন তরুণী। তিনজনের সাজসজ্জা এ রকম যে দেখে মনে হচ্ছে তারা কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে। কিছু দর্শকও উপস্থিত আছে। দর্শকরা শুধু যে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তা-না। মাঝে মাঝে তাদের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাচ্ছে। যেন এমন অপূর্ব দৃশ্য তারা তাদের মানব জীবনে কখনো দেখেনি। ভবিষ্যতে দেখবে এই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, পিজার জন্মভূমি ইতালি। তবে এই খাবার এখন সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও। ঢাকা শহরে কতগুলো পিজা আউটলেট আছে আপনারা কি জানেন? ক্যামেরা চলে গেল দর্শকের মুখে। দর্শকরা চিন্তিত হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। একজন বলল, পঞ্চাশটি।
রাঁধুনী কপালে এসে পড়া চুলগুলো ঝাঁকি দিয়ে সরাতে সরাতে বলল, হয়নি। আর কেউ কি উত্তর দেবেন? যার উত্তর কাছাকাছি হবে তার জন্যে পুরস্কার আছে।
একশ।
তিনশ পঞ্চাশ।
এক হাজার।
তিনি টিভির ভ্যলুম একটু বাড়িয়ে দিলেন। ঢাকা শহরে কতগুলো পিজা আউটলেট আছে এটা জানা এই মুহূর্তে তার কাছে জরুরি বলে মনে হচ্ছে। তিনি ঠিক করলেন, এই ফাঁকে পিজা রান্নাটাও শিখে নেবেন। পিজা তাঁর কোনো পছন্দের খাবার না। তারপরেও নতুন একটা রান্না শিখে নিতে কোনো সমস্যা নেই। ইংরেজিতে একটা কথা আছে— Even an old dog can learn few new tricks.
মবিনুর রহমানের বয়স সাতান্ন। মাঝারি আকৃতির ছোটখাটো মানুষ। চেহারায় বয়সের ছাপ তেমন ভাবে না পড়লেও মাথার চুল সবই সাদা। এই বয়সে মাথার চুল কমে যায়। কপাল বড় হয়। তাঁর বেলায় এই ঘটনা ঘটেনি। মাথা ভর্তি সাদা চুলের কারণে এবং গোঁফের কারণে তাকে অনেকটা আইনস্টাইনের মতো দেখায়। তিনি কপ দেন না। কলপের কোনো একটা ইনগ্রেডিয়েন্টে তাঁর এলার্জি আছে। দেশী-বিদেশী যে কলপই দেন, তার গায়ে চাকা চাকা বের হয়।
মাথার সাদা চুল তার পছন্দ না। বেশির ভাগ সময় তিনি মাথায় ক্যাপ পরে থাকেন। নানা ধরনের ক্যাপ তার আছে। এখন তিনি যে ক্যাপ পরে আছেন, সেটা আফগান মুজাহেদিন ক্যাপ। দেখতে অনেকটা কাগজের ঠোঙ্গার মতো। একটা ভঁজ দিয়ে মাথায় দিতে হয়। তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে পাতলা ফতুয়া। তিনি টিভি পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে ডাকলেন, ম্যানেজার।
শফিকুল করিম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল। ঘরে ঢুকল না। দরজার ওপাশ থেকে ক্ষীণ গলায় বলল, স্যার ডেকেছেন?
তিনি বললেন, ভেতরে আসে। আমি যখন ডাকব আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়াবে। দূরে দাঁড়াবে না। তোমার নাম যেন কী?
শফিকুল করিম।
এত বড় নাম তো আমার মনে থাকবে না। ছোট নাম আছে? আমাকে শফিক ডাকতে পারেন। শফিক ছাড়া আর কিছু? শফিক ডাকতে পারব না। শফিক নামে আমার একজন কর্মচারী ছিল, বিরাট বদ। শফিক বলে ডাকলে তার কথা মনে পড়বে। আর কোনো নাম?
বাবুল ডাকতে পারেন। আমার বাবা আমাকে বাবুল ডাকেন।
নতুন নামে অভ্যস্ত হতে আমার সময় লাগে। যতদিন অভ্যস্ত না হব ম্যানেজার ডাকব। তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?
না স্যার।
কয়টা বাজে?