চিঠি অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আর লম্বা করা ঠিক না। ভালো কথা, তোমাদের ঐদিকে কি বৃষ্ট পড়ছে? এদিকে ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হয় এ বছর বন্যা হবে।
তুমি ভালো থেকো।
মবিনুর রহমান
পুনশ্চ : মেয়েদের আমার স্নেহ চুম্বন দিও।
লায়লাকে লেখা চিঠিতে সামান্য মিথ্যা বলা হলো— এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে না অথচ তিনি লিখেছেন বৃষ্টি হচ্ছে। চিঠি যদি সত্যি সত্যি লেখা হতো তাহলে এই মিথ্যা তিনি ঠিক করতে পারতেন। যে চিঠি মনে মনে লেখা হয় সেই চিঠি ঠিক করা যায় না। মনের কোনো লেখাই নষ্ট করা যায় না। মস্তিষ্কের কোনো ইরেজ সিস্টেম নেই।
মবিনুর রহমান সিগারেট ধরালেন। মুন্সি ইদরিসকে চিঠি লেখার জন্যে তৈরি হলেন। এই চিঠি সাবধানে লিখতে হবে। এখানে ভুলভাল থাকলে চলবে না। সিগারেট টানতে টানতেও এই চিঠি লেখা যাবে না। এটা বেয়াদবি হবে। মবিনুর রহমান আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিলেন। চোখ বন্ধ করলেন। মুন্সি ইদরিসকে লেখার সময় চিঠির ওপর সংখ্যা লিখতে হবে ৭৮৬-এর অর্থ বিসমিল্লাহ হির রহমানুর রহিম। সম্বোধন হতে হবে পোশাকি—
৫৭১
বড় হুজুর সমীপেষু
আসসালামু আলায়কুম।
দ্বিতীয় কোনো লাইন মাথায় আসছে না। এটা কেমন কথা? আর কিছু মাথায় আসছে না কেন? মবিনুর রহমান অস্থিরবোধ করছেন। একটু আগে শীত শীত লাগছিল। এখন লাগছে না। তাঁর কপাল কি ঘামছে। তিনি চাদরের নিচ থেকে হাত বের করে কপালে রাখলেন। কপাল ঘামছে। তিনি ভীত গলায় ডাকলেন, বাবুল, বাবুল। ম্যানেজার।
বাবুর্চি গনি মিয়া বলল, স্যার কিছু লাগবে? বাবুর্চি গনি মিয়াকে তিনি চলে যেতে বলেছিলেন। সে যায়নি। এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়েছিল। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মুন্সি ইদরিসের সঙ্গে কেউ অপরাধ করলে তার শাস্তি হতো। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে তাকে কানে ধরে উঠবোস করতে হতো।
মুন্সি ইদরিস বলতেন, আমি কোনো অপরাধ ক্ষমা করি না। ক্ষমা করবেন আল্লাহপাক। তিনি রহমানুর রহিম। যে যত অপরাধই করুক ক্ষমা পেয়ে যাবে; কারণ আল্লাহর রহমতের চেয়ে বেশি অপরাধ কেউ করতে পারবে না।
গনি মিয়া।
জি স্যার।
পানি খাব। পানি আনো।
স্যার এই নিন পানি।
এই নিন পানি মানে? তুমি কি পানির গ্লাস হাতে আমার পিছনে দাঁড়িয়েছিলে?
জি স্যার।
কেন?
আমার মনে হচ্ছিল আপনি পানি চাইবেন।
মবিনুর রহমান এক চুমুকে পানির গ্লাস শেষ করে গ্লাস ফেরত দিতে দিতে বললেন, গ্লাস হাতে ঘাপটি মেরে এতক্ষণ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার কাজটা তুমি করেছ আমাকে চমকে দেবার জন্যে। তুমি ভেবেছ আমি চমকে যাব এবং খুশি হব। আমি চমক পছন্দ করি না। বায়েজীদ বোস্তামী তার মার জন্যে পানি গ্লাস হাতে সারারাত জেগেছিলেন। তুমি বায়েজীদ বোস্তামী না। তুমি বাবুর্চি গনি মিয়া।
স্যার আমার ভুল হয়েছে। আপনার কাছে ক্ষমা চাই।
আমি কাউকে ক্ষমা করি না। ক্ষমার মালিক আল্লাহপাক। তুমি তোমার ভুলের জন্যে কানে ধরে দশবার উঠবোস করো।
গনি মিয়া উঠবোস করছে। তার কোমরে কিংবা হাঁটুতে বোধ হয় কোনো সমস্যা আছে। এক একবার উঠবোস করছে কটকট শব্দ হচ্ছে।
দশবার কি শেষ হয়েছে?
জি স্যার।
কানে ধরে উঠবোস করানোর শাস্তি দেয়ার পদ্ধতি আমি কার কাছ থেকে শিখেছি জানো?
জানি স্যার। আপনি বলেছিলেন মুন্সি ইদরিস।
ঠিক বলেছ। আমরা তাঁকে বড় হুজুর ডাকতাম। অতি কঠিন লোক। কেউ অন্যায় করেছে আর তিনি তাকে শাস্তি দেন নাই এরকম হয় নাই। একবার তাকে খুশি করার জন্যে এতিমখানার দারোয়ান বলল, বড় হুজুর আপনি ফেরেশতার মতো আদমি। বড় হুজুর বললেন, তুমি তো অন্যায় কথা বলেছ, সব মানুষের অবস্থান ফেরেশতার ওপরে। তুমি আমাকে ফেরেশতার মতো বলে ছোট করেছ। পশ্চিম দিকে ফিরে কানে ধরে উঠবোস করো। উনি কেমন মানুষ ছিল বুঝতে পারছ গনি মিয়া?
জি স্যার।
শফিক কোয়ার্টার পেয়েছে
শফিক কোয়ার্টার পেয়েছে।
আগারগাঁয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের তিন নম্বর ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট দেখে মীরা হতভম্ব। শোবার ঘরই চারটা। মেঝেতে টাইলস বসানো। বাথরুম তিনটা। একটায় আবার বাথটাব আছে। রান্নাঘরটাও এত সুন্দর। কিচেন কেবিনেট ঝকঝক করছে। মাছ, তরকারি কোটার জন্যে টেবিলের মতো আছে। টেবিলটা মনে হয় মার্বেলের। মীরার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে চোখের পানি সামলাতে সামলাতে নিশোর দিকে তাকিয়ে বলল, বাসা পছন্দ হয়েছে মা?
নিশো বলল, আমাদের ফ্রিজ কোথায়?
মীরা বলল, ফ্রিজ কেনা হবে। যা যা দরকার সবই আস্তে আস্তে কেনা হবে।
নিশো বলল, আমরা কী বড়লোক হয়ে গেছি মা?
মীরা বলল, হ্যাঁ হয়েছি।
মনোয়ারা ফ্ল্যাট বাড়ির নানা খুঁত বের করলেন যেমন একটা বাথরুমের কমোড পশ্চিম দিক করে বসানো। বারান্দা চিপা। রান্নাঘর দক্ষিণে। চুলার ধোয়া শোবার ঘরে ঢুকবে।
মীরা বলল, মা আপনার ফ্ল্যাট পছন্দ হয়নি?
মনোয়ারা বললেন, অন্যের বাড়ির আবার পছন্দ অপছন্দ কী? তুমি এরকম আহ্লাদি করছ যেন নিজের বাড়ি। এখন বলো আমার ঘর কোনটা?
মীরা বলল, যে ঘরটা আপনার পছন্দ আপনি সেই ঘরেই থাকবেন।
বারান্দাওয়ালা ঘরটা আমাকে দিও। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে বারান্দায় বসব। আর শোনো তোমার শ্বশুরের জন্যে আলাদা ঘর দাও। ইংরেজিওয়ালাকে নিয়ে এক ঘরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।
মীরা দুদিনের মধ্যে ঘর সাজিয়ে ফেলল। জানালায় নতুন পর্দা। বাথরুমে শাওয়ার কার্টেন। বারান্দায় দড়িটানা চিক। শাশুড়ির নামাজের জন্যে নতুন জায়নামাজ। একটা দামি টিসেট কিনল। এক ডজন গ্রাস কিনল। ছয়টা প্লেট কিনল। এই বাড়িতে পুরনো কিছুই মানাচ্ছে না। সব নতুন লাগবে। সব নতুন কেনার টাকা কোথায়?