বাবুর্চি তার গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে দিয়েছে। খুবই যত্ন করে সে চাদরটা দিয়েছে। তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন এই যত্নটা কতটা সে মন থেকে করছে? আর কতটা চাকরির অংশ হিসেবে করছে।
তোমার নাম তো মনসুর?
জি স্যার। এই সব খুঁটিনাটি জিনিস আমার মনে থাকে না। তোমারটা মনে আছে?
জি স্যার। স্যার আপনার পা ম্যাসেজ করে দিব?
দাও, তার আগে মোবাইল টেলিফোনটা আনো তো দেখি, আমার ম্যানেজারকে একটা টেলিফোন করি।
মনসুর টেলিফোন এনে দিল। মবিনুর রহমান টেলিফোন হাতে নিতে নিতে বললেন, তোমার কি মনে হয় এত রাতে টেলিফোনে তার ঘুম ভাঙালে সে কি রাগ করবে?
জি না স্যার।
রাগ করবে না কেন? আমি তার অন্নদাতা এই কারণে?
জি স্যার।
তুমি তো ভালই ম্যাসাজ করতে পারো। ঘুম এসে যাচ্ছে?
জি স্যার।
মবিনুর রহমান টেলিফোন হাতে বসে আছেন। বাবুলের ঘুম ভাঙাবেন কিনা এখনো বুঝতে পারছেন না। হয়তো ভাঙাবেন। হয়তো ভাঙাবেন না। সিদ্ধান্ত নেবার সময় এখনো আছে। এখন মনসুরের সঙ্গে কথা বলে আরাম পাচ্ছেন। সে যদিও জি স্যার ছাড়া আর কিছুই বলছে না। এটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার যে রাতে তার কোমল গলায় জি স্যার শুনতে তার ভাল লাগছে।
মনসুর।
জি স্যার।
মানুষ হিসেবে আমাকে তোমার কেমন মনে হয়?
আপনের মতো মানুষ স্যার আমি আমার এই জীবনে দেখি নাই।
তুমি কি এই কথাটা আমাকে খুশি করার জন্য বলেছ?
জি না স্যার। আমার বড় মেয়েটার চিকিৎসার সব খরচ আপনি দিয়েছিলেন। তারে আপনি ইন্ডিয়াতে পাঠায়েছিলেন।
লাভ তো হয় নাই। তোমার মেয়ে মারা গেছে।
জি স্যার।
তোমার মেয়েটার নাম যেন কী ছিল? আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে বলতে হবে দেখি আমি বলতে পারি কিনা, রুমা, তার নাম রুমা। হয়েছে?
জি স্যার।
তুমি বলেছিলে তোমার মেয়ের মৃত্যুর পর তার মা পাগল হয়ে গিয়েছিল–এখন তার অবস্থা কি?
মনসুর জবাব দিল না। মাথা নিচু করে পা মালিশ করতে লাগল। মবিনুর রহমান নড়েচড়ে বসলেন। হালকা গলায় বললেন, আমি এক সময় শুনেছিলাম তুমি তোমার পাগল স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আবার বিবাহ করেছ। এটা কি সত্যি?
জি স্যার।
তোমার মেয়ের মৃত্যু শোকে যে মেয়ে পাগল হয়ে গেছে তাকে তালাক দিয়ে আবার বিয়ে করাটা দুষ্ট লোকের লক্ষণ। তুমি যে দুষ্টু লোক এটা জানো?
মনসুর জবাব দিল না। তার হাত কাঁপতে লাগল। মবিনুর রহমান ঘুম ঘুম গলায় বলল, আমি অবশ্য আমার আশপাশে দুষ্টু লোক রাখতে পছন্দ করি। কেন করি জানো?
জি না স্যার।
আশপাশে দুষ্টু লোক দেখতে পেলে আমার মন ভালো থাকে। তখন আমার মনে হয় ওদের তুলনায় আমি তো অনেক ভালো। আমি যদি সাধু সন্ন্যাসীদের নিয়ে থাকতাম তাহলে নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে হতো। মনুসর ঠিক বলেছি?
জি স্যার।
তোমার পরিচিত কেউ আছে যে খুন করেছে? খুনের ব্যাপারটা প্রকাশ হয়নি বলে তার শাস্তি হয়নি। সেরকম কেউ থাকলে আমি তাকে একটা পার্মানেন্ট চাকরি দিতাম। তাকে সব সময় রাখতাম আমার আশপাশে। তোমার চেনাজানার মধ্যে এরকম কেউ আছে?
জি না স্যার।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে না?
জি স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি চলে যাও।
আরেক কাপ চা এনে দিব স্যার?
না। আমার ক্যাপটা এনে দাও। মাথায় ঠাণ্ডা লাগছে।
মাথায় ক্যাপ পরায় খুবই আরাম লাগছে। ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লে আরামটা চলে যাবে। ঘুমন্ত শরীর আরাম টের পায় না। মবিনুর রহমান জেগে থাকার চেষ্টা করতে লাগলেন। যখন ঘুম পায় অথচ ঘুমুতে ইচ্ছা করে না তখন জেগে থাকার জন্যে মবিনুর রহমান তার নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করেন। পদ্ধতির নাম পত্ৰলেখা পদ্ধতি। তিনি মনে মনে চিঠি লেখেন। বেশির ভাগ চিঠি বাবুপুরী এতিমখানায় সুপারিনটেন্টনকে লেখেন। এই মানুষটা মারা গেছেন। তাতে চিঠি লিখতে তার সমস্যা হয় না। হঠাৎ হঠাৎ লায়লাকে লেখেন। লায়লাকে চিঠি লেখার সময় তার সামান্য লজ্জাবোধও হয়। লায়লাকে চিঠি লেখার সময় তিনি এমন ভাব করেন যে লায়লা তারই স্ত্রী। কোনো কারণে সে ছেলেমেয়ে নিয়ে আলাদা বাস করছে। লায়লাকে লেখা চিঠিতে প্রেম-ভালবাসা জাতীয় কিছু থাকে না। প্রয়োজনের চিঠির মতো হয়।
মবিনুর রহমান চোখ বন্ধ করে চিঠি শুরু করলেন—
লায়লা,
আমার ম্যানেজারকে দিয়ে কিছু আম পাঠিয়েছিলাম। পেয়েছ তো? তোমার মেয়ে কি আম পছন্দ করে? তোমার মেয়েকে আমার স্নেহাশিস দিও। তোমার স্কুলের চাকরি কেমন চলছে? শরীরের ওপর বেশি চাপ পড়লে চাকরি ছেড়ে দাও। অবসর নাও। আমি যেমন অবসর জীবনযাপন করছি সেরকম অবসর। কাজ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। অবসরও কিন্তু এক ধরনের কাজ এবং বেশ জটিল কাজ।
আমার কথাই বলি– নিজের অবসরটা কিভাবে কাটাব তা নিয়ে আমাকে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর চিন্তা করতে হয় আজকের দিনটা কিভাবে কাটাব। আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। স্মৃতিশক্তির সমস্যা হচ্ছে। অনেক কিছু পুরোপুরি মনে করতে পারি না।
ভালো কথা, স্বপ্ন সম্পর্কে তুমি কি কিছু জানো। নিজেকে মৃত স্বপ্নে দেখলে কী হয়? বাবুপুরা এতিমখানার সুপার মুন্সি ইদরিস স্বপ্ন বিষয়ে অনেক কিছু জানতেন। কেউ কোনো কিছু স্বপ্ন দেখলেই বলে দিতেন স্বপ্নের অর্থ কি। একবার আমি স্বপ্নে দশ-বারোটা সাপ দেখেছিলাম। আমি একটা ডোবার মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, আমার চারদিকে সাপ কিলবিল করছে। স্যারকে স্বপ্নের কথা বলতেই তিনি বললেন–তোর কোনো বড় অসুখ-বিসুখ হবে। সত্যি সত্যিই আমার টাইফয়েড় হয়েছিল।