মীরা বলল, কিছু চাও? চা খাবে।
শফিক বলল, না। কবিতা শুনবে?
মীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
শফিক বলল, এক সময় প্রচুর কবিতা মুখস্থ করেছিলাম এখন বোধ হয় কিছুই মনে নেই। দেখি চেষ্টা করে। করব চেষ্টা?
মীরা শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল, বল। মীরার চোখে পানি এসে গেছে। বিয়ের পর পর রোজ রাতে শফিক কবিতা বলত। কি আনন্দটাই না তখন লাগত। তারপর সব বন্ধ হয়ে গেছে। আজ কত দিন পর সে কবিতা শুনাতে চাচ্ছে। আহারে কি আনন্দ!
No. Mr. Lawence. It is tot like that!
I dont mind telling you
I know a thing or two about love
Perhaps more than you do.
And what I brow is that you make it
Tod nice. Too beautiful.
It is not like that. You know; You fake it.
It is really rather dull.
মীরা মাথা নিচু করে আছে। মাথা নিচু করে থাকার কারণে টপটপ করে চোখের পানি পড়ছে তার শাড়িতে। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার বলে এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটা শফিক দেখছে না।
মীরার খুব ইচ্ছা করছে শফিকের হাত ধরতে। সে ভরসা পাচ্ছে না। ইদানীং শফিকের মেজাজ খারাপ যাচ্ছে। হাত ধরলে হয়তো বলে বসবে— আহাদি করবে না। তখন মন খারাপ হবে।
মীরা কবিতাটার মানে বুঝতে পেরেছ?
না।
মানে হচ্ছে–ভালবাসা নিয়ে তোমরা যে এত মাতামাতি কর–সেটা ঠিক RI
মীরা বলল, তোমার ঐ কবি ভালবাসা কি বুঝতেই পারেনি।
তুমি বুঝেছ?
হ্যাঁ বুঝেছি।
তাহলে বল ভালবাসা কি?
মীরা লাজুক গলায় বলল, ভালবাসা হচ্ছে মাঝরাতে তোমার হাত ধরে বসে থাকা।
কই হাত ধরছ না তো।
মীর হাত ধরল। আর তখনি শোবার ঘর থেকে ঠকঠক শব্দ হতে থাকল। কেউ যেন ভারি কিছু দিয়ে মেঝেতে বাড়ি দিচ্ছে। মীরা চিন্তিত গলায় বলল, কি হচ্ছে?
শফিক বলল, মা তার পুরনো খেলা খেলছেন।
তার মানে?
বাবাকে বিরক্ত করছেন। বাবা যাতে ঘুমাতে না পারেন সেই ব্যবস্থা হচ্ছে। মা সারারাত চুক চুক করবেন। আগে অনেকবার দেখেছি।
সারারাত এ রকম চলবে?
শফিক হাই তুলতে তুলতে বলল, সারারাতই চলার কথা। এসো ঘুমুবার চেষ্টা করি।
শফিক সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে রইল মীরা। ঠুকঠুক শব্দ হয়েই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্যে থমকে আবারো শুরু হচ্ছে জোরালোভাবে।
রাত তিনটায় মবিনুর রহমানের ঘুম ভেঙেছে। এই সময়ে প্রায়ই তার ঘুম ভাঙে। তাকে বাথরুমে যেতে হয়। আজকের ঘুম ভাঙার কারণ ভিন্ন। তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।
তিনি তাঁর নিজের বাড়ির বারান্দায় মরে পড়ে আছেন। একটা লেজ লম্বা হলুদ পাখি ঠুকরে ঠুকরে তার বাঁ চোখটা তুলে নিয়েছে। মৃত মানুষের কোন ব্যথা বোধ থাকে না। থাকার কথা না অথচ স্বপ্নে তিনি বাঁ চোখে ব্যাথা পাচ্ছেন। পাখিটা এক একবার ঠোকর দিচ্ছে তিনি ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দ্রুত বদলায়, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি দেখলেন পাখিটা হলুদ না— এটা আসলে একটা কাক। কাকের ঠোঁট স্বাভাবিকের তুলনায় লম্বা। চোখ উঠিয়ে নেয়ায় যে গর্তটা হয়েছে কাক সেই গর্তে ঠোঁট চুকিয়ে দিচ্ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে বা চোখ না থাকলেও তিনি কাকের ঠোঁট দেখতে পাচ্ছেন।
মবিনুর রহমান বিছানা থেকে নামলেন। বাথরুমে ঢুকে চোখে-মুখে পানি দিলেন। দরজা খুলে বারান্দায় এলেন। বারান্দায় যেখানে তাঁর ডেডবডি পড়েছিল সেই জায়গাটা তার দেখার ইচ্ছা। বারান্দা অন্ধকার। সুইচ বোর্ডটা কোথায় তিনি মনে করতে পারলেন না। দেয়াল হাতড়ালেই সুইচ বোর্ড খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি দেয়াল হাতড়াতে শুরু করলেন। আর তখনি মনে হলো বারান্দার শেষ মাখা থেকে পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কে যেন আসছে। রাত তিনটায় বারান্দায় কোন লোক থাকার কথা না। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কে?
স্যার আমি।
তুমি কে?
স্যার আমার নাম হরমুজ। আমি নাইট গার্ড।
কাছে আসো।
নাইট গার্ড তাঁর কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। তার গায়ে খাকি পোশাক। হাতে টর্চ। পায়ে বুটজুতা।
তুমি নাইট গার্ড?
জি স্যার।
তোমার ডিউটি কোথায়?
রাত বারটা থেকে আমার ডিউটি বারান্দায়।
এখন কয়টা বাজে?
জানি না স্যার।
এখন বাজে রাত তিনটা। তুমি তো বারান্দায় ছিলে না।
নিচে পিসাব করতে গিয়েছিলাম স্যার।
তোমার নাম যেন কী?
হরমুজ।
হরমুজ শোনো, তোমাকে এখন বারান্দায় থাকতে হবে না। নিচে থাক। বাবুর্চিকে ডেকে তুলে বলো আমি চা খাব।
তিনি বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসলেন। এখন আর বারান্দা অন্ধকার না। খুবই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। তাঁর ডেডবডি যে জায়গায় পড়েছিল সেই জায়গাটাও দেখা যাচ্ছে। তবে স্বপ্নের বারান্দার সঙ্গে বাস্তবের বারান্দার কোন মিল নেই। স্বপ্নের বারান্দায় ছুঁচলো লোহার শিক ঘন ঘন বসানো ছিল। তার বারান্দায় সে রকম কিছু নেই।
তার ঘুম পাচ্ছে। ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তো। এই সময়ের নিয়ম দূরের বৃষ্টি এক সময় এগিয়ে আসে। মৌসুমী হাওয়ার সময় খণ্ড খণ্ড বৃষ্টি হয় না। দেশ জুড়ে বৃষ্টি হয়।
স্যার চা।
টেবিলে রেখে চলে যাও।
স্যারের কি শরীর ঠিক আছে?
আমার শরীর ঠিক আছে, ঠাণ্ডা লাগছে পাতলা একটা চাদর দিয়ে যাও। বারান্দায় গার্ডের কাজ যে করে তার নাম কি? নাম বলেছিল ভুলে গিয়েছি।
স্যার গার্ডের নাম হরমুজ।
তিনি হরমুজ নাম মনে রাখার চেষ্টা করতে লাগলেন। হরমুজের সঙ্গে মিল রেখে কয়েকটা শব্দ বলতে হবে। তাহলেই নাম মাথার ভেতর গাঁথা হয়ে যাবে। হরমুজ তরমুজ। হরমুজ তরমুজ। হরমুজ তরমুজ।