সুরমা এসে বাবাকে বলল, বাবা তুমি এখনো বসার ঘরে বসে আছ? মার কাছে যাও।
তিনি বললেন, যাচ্ছিরে মা যাচ্ছি, একটু রেস্ট নিয়ে তারপর যাই। শফিককে খবর দিয়েছিস?
খবর দিয়েছি।
শফিকের জন্যে একটু অপেক্ষা করি, বাপ-বেটা একসঙ্গে যাই। আমাকে দেখলে তোর মা আবার ইয়ে হয়ে যাবে।
সুরমা বলল, মা চেঁচামেচি করবে। তুমি চুপ করে শুনবে।
জয়নাল সাহেব হতাশ গলায় বললেন, অবশ্যই অবশ্যই। এককাপ চা দে। চা খেয়ে তারপর যাই। জামাই কোথায়?
এম্বুলেন্সের জন্যে গেছে।
জয়নাল সাহেব কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেন। মনোয়ারা তাঁকে দেখে যেসব কথাবার্তা শুরু করবেন সেসব কথা জামাই বা পুত্রবধূ শ্রেণীর কারোরই শোনা উচিত না।
সুরমা বলল, চী পরে খাবে আগে র কাছে যাও।
মনোয়ারার মাথার নিচে একটা বালিশ দেয়া হয়েছে। অনেক কায়দা করে একটা টেবিল ফ্যান লাগানো হয়েছে। টেবিল ফ্যানের সমস্যা হলো একটু পরপর ফ্যান ঘুরে যাচ্ছে। সুরমার বড় মেয়ের দায়িত্ব হলো ঘুরে যাওয়া ফ্যান ঠিক করে দেয়া। মেয়েটার নাম রুনি। ক্লাস সেভেনে পড়ে। অতি ভাল মেয়ে। এই বয়সের একটা মেয়ে এক নাগাড়ে এতক্ষণ বাথরুমে বসে থাকতে পারে না। সে শান্ত ভাবেই বসে আছে। এর মধ্যে মনোয়ারা তার নাতনীর গালে একটা চড়ও দিয়েছেন। সে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ কেঁদে আবার চুপ হয়ে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। জয়নাল সাহেব এসে রুনির পাশে বসলেন। মনোয়ারা স্বামীর দিকে
তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, তুমি ভাল আছ?
জয়নাল সাহেব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন?
তোমার কাছে একশটা টাকা হবে?
অবশ্যই হবে।
তাহলে একটা কাজ কর একশ টাকা নিয়ে ওষুধের দোকানে যাও, আমার জন্যে একশ টাকার ঘুমের ওষুধ কিনে আনো।
এক্ষুণি যাচ্ছি। ওষুধের নাম বল।
নামধাম লাগবে না। ঘুমের ওষুধ হলেই হবে। এই ওষুধ আমি তোমার সামনে খাব। খেয়ে মরে যাব। স্বামীর ভাত খাওয়ার সৌভাগ্য আমার কপালে নাই। স্বামীর কিনে দেয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে মারা গেছি। এটা বলার মধ্যে আনন্দ আছে না? বিরাট আনন্দ।
জয়নাল সাহেব অপ্রস্তুত চোখে রুনির দিকে তাকালেন। শুরুটাই এ রকম শেষ কি রকম হবে কে জানে! মনোয়ারার মুখ ছুটে গেলে সর্বনাশ।
মনোয়ারা বললেন, আমাকে মেয়ের ঘাড়ে ফেলে দিয়ে হোটেলে বসে মচ্ছব কর। মেয়ে জামাই আমাকে কি চোখে দেখে কোন দিন খোঁজ নিয়েছ?
জয়নাল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, সুরমা তোমার খুবই যত্ন করে। ফরিদও অতি ভাল ছেলে।
মনোয়ারা বললেন, বিড়বিড় করে সাপের মন্ত্র কি পড়তেছ। যা বলার পরিস্কার করে বল।
রুনি তার নানাকে চোখে ইশারা করল চুপ করে থাকতে। জয়নাল সাহেব চুপ করে গেলেন।
মনোয়ারা বললেন, খেয়ে না খেয়ে যে আছি এটা কি জানো? দুপুরে পান কিনে খাব। একটা পানের দাম পঞ্চাশ পয়সা। পঞ্চাশ পয়সার জন্যে জনে জনে হাত পাততে হয়। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে এরা কেক-পেস্ট্রি খায়, একবার জিজ্ঞেসও করে না— অম্মাি কেক খাবেন? বাড়িতে যখন কেউ কুত্তা পালে তার দিকেও এক টুকরা কেক বাড়ির মালিক ছুড়ে দেয়।
জয়নাল সাহেবের খুবই লজ্জা লাগছে। রুনির সামনে এইসব কথা। মেয়েটা কি লজ্জাই না পাচ্ছে। সুরমাও নিশ্চয়ই শুনছে। সে তেমন লজ্জা পাবে না। কারণ মার স্বভাব সে জানে। জয়নাল সাহেব নিচু গলায় বললেন, শান্ত হও। তোমার শরীরটা খারাপ। মনোয়ারা বললেন, আমি শান্ত হব আর তোমরা সবাই অশান্ত থাকবে। হোটেলে যখন থাক তখন শান্ত থাক, না অশান্ত থাক?
তোমার কথা বুঝলাম না।
আমার কথা কীভাবে বুঝবে? আমার হলো অশান্ত কথা। তুমি বুঝবে শান্ত কথা। শান্ত কথা তোমাকে কে বলে ঠিক করে বল তো? হোটেলে বাজারের মেয়েছেলে আসে? তোমার কী বাঁধী কেউ আছে? এইসব হোটেলে কি চলে তা আমি জানি।
জয়নাল সাহেব শরমে মরে যাচ্ছেন। বাচ্চা একটা মেয়ে পাশে বসে আছে, না জানি সে কি মনে করছে।
মনোয়ারা বললেন, এই যে ইংরেজিওয়ালী এখন সব কথা মন দিয়ে শোন— আমি যদি এই বাড়িতে থাকি তাহলে এই বাথরুমে পড়ে থাকব। আমাকে বাথরুম থেকে তুলতে হলে হয় তুমি তোমার হোটেলে নিয়ে তুলবে আর নয় তোমার গুণধর ছেলেকে বলবে তার বাসায় নিয়ে তুলতে। ছেলে শুনেছি মহাতালেবর হয়েছে। গাড়ি করে ঘুরে বেড়ায়। মেলা বেতন। বউ কোলে নিয়ে এখন বসে থাকে। বুড়া মায়ের খোঁজ নাই।
জয়নাল সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, ব্যবস্থা হবে।
মনোয়ারা বললেন, ব্যবস্থা যেন আজকেই হয় তোমার গুণধর ছেলেকে বলবে সে যেন আজই আমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করে।
বলব। অবশ্যই বলব। সে আসুক।
আর তুমিও আমার সঙ্গে থাকবে। তোমাকে আর হোটেলে থাকতে দেব না। হোটেলে থাকবে আর নটি মেয়েদের দুধ ছানাছানি করবে তা হবে না।
রুনি লজ্জা পেয়ে উঠে চলে গেল। জয়নাল সাহেব মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলেন; কারণ আল্লাহপাক মেয়েটাকে উঠে চলে যাবার মতো বুদ্ধি দিয়েছেন।
রাত দশটায় শফিক মা এবং বাবাকে তার বাসায় নিয়ে এলো। মনোয়ারার সিটিস্ক্যান করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকলেই হবে।
মীরা তার শোবার ঘর শ্বশুর-শাশুড়িকে ছেড়ে দিয়েছে। তারা শুতে এসেছে বসার ঘরে। মীরা মেয়েকে নিয়ে মেঝেতে বিছানা পেতেছে। শফিক পা গুটিয়ে শুয়েছে লম্বা সোফায়। সারাদিন মীরার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে। শোয়ী মাত্রই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। শফিক নরম গলায় তাকে ডাকল।